নিউজ ডেস্ক:
হজরত আলী (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যখন আমার উম্মতের মাঝে ১২টি (কোনো কোনো বর্ণনায় ১৫টি) কাজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে তখন তাদের ওপর মসিবতের পাহাড় ভেঙে পড়বে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, কাজগুলো কী?
উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন-
১. যখন রাষ্ট্রীয় সম্পদকে লুটের মাল মনে করা হবে।
২. যখন আমানতের মালকে লুটের মাল মনে করা হবে এবং তাতে খেয়ানত করবে।
৩. যখন লোকেরা জাকাতকে জরিমানা এবং ট্যাক্স মনে করবে।
৪. মানুষ স্ত্রীর আনুগত্য করবে এবং মায়ের অবাধ্যতা করবে। অর্থাৎ মানুষ স্ত্রীকে খুশি করার জন্য মাকে অসন্তুষ্ট করবে।
৫. মানুষ বন্ধুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে এবং বাবার সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করবে। এর মানে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করবে কিন্তু বাবার সঙ্গে রূঢ় ও কঠোর আচরণ করবে।
৬. মসজিদে শোরগোল হবে।
৭. সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে নেতা বানানো হবে।
৮. অনিষ্টের ভয়ে মানুষকে সম্মান করা হবে।
৯. ব্যাপকভাবে মদ পান করা হবে।
১০. ব্যাপকভাবে রেশমি কাপড় পরিধান করা হবে।
১১. ঘরে নর্তকী ও গায়িকা রাখা হবে এবং বাদ্যযন্ত্র ও নাচ-গানের উপকরণকে যত্নসহকারে রাখা হবে।
১২. এ উম্মতের পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের ওপর অভিসম্পাত করবে।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এ বর্ণনা করে বলেন, এ আলামতগুলো যখন মুসলিম সমাজে দেখা দিবে তখন মসিবতের পাহাড় ভেঙে পড়বে। এ আলামতগুলোর বেশির ভাগই আজ আমাদের সমাজে বিদ্যমান। আমাদের সমাজে এমন অনেক বিষয় আছে যা আমাদের জিম্মি করে ফেলেছে।
নিচে সেগুলোর কয়েকটি তুলে ধলা হলো-
মাদক: বর্তমান যুগে সত্যিই মদকে মদ মনে করা হয় না। বিভিন্ন নাটক-সিনেমায় মদকে অত্যন্ত হালকা করে প্রদর্শন করা হয়। বাবা-ছেলে একসঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে মদ খাচ্ছে, এমন চিত্র প্রদর্শন করা হয়। বিভিন্ন পার্টিতে এখন মদ রাখা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, সারা বছর মদ পান না করলেও কেউ কেউ বিভিন্ন দিবসে পার্টির নামে মদ পান করছে। আল্লাহ আমাদের কে এসব থেকে হেফাজত করুন।
সুদ
সুদ তো আমাদের সমাজে এতটাই ব্যাপক হয়ে গেছে যে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে—সুদবিহীন অর্থনীতি চিন্তাই করা যায় না। সুদ ব্যবস্থা বন্ধ করতে গেলে অর্থনীতিই ভেঙে পড়বে। অথচ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
ঘুষ
যখন আমার উম্মত ঘুষকে উপহার বলে হালাল করবে। কেউ কেউ ঘুষকে বলেন, স্পিড মানি। আজকাল ঘুষদাতা উপহার দিলাম বলে ঘুষ দিচ্ছে এবং ঘুষ গ্রহণকারীও তাই বলছে। যখন আমার উম্মত জাকাতের মালকে ব্যবসার মাল রূপে গণ্য করবে তখন উম্মতের ওপর ধ্বংস নেমে আসবে। এ চারটি বিষয় আলোচ্য হাদিসে রাসুল (সা.) উল্লেখ করেছেন। এগুলো আজ আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।
গাড়িতে চড়ে মসজিদে আসবে
এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ফিতনার যুগে লোকেরা ‘মায়াসির’-এর ওপর আরোহণ করে আসবে এবং মসজিদের দরজায় এসে নামবে। ‘মায়াসির’ আরবি শব্দ। মূল্যবান রেশমি কাপড়কে ‘মায়াসির’ বলা হয়। সে যুগে রাষ্ট্রীয় লোকেরা ঘোড়ার পিঠের গদির ওপর এটি ব্যবহার করত। আগের যুগে এটি কল্পনা করা কঠিন ছিল যে একজন মুসলমান মূল্যবান রেশমি কাপড়ে নির্মিত গদির ওপর আরোহণ করে কীভাবে মসজিদে আসবে? কিন্তু বর্তমানে নানা রকম মোটরগাড়ি আবিষ্কৃত হওয়ায় এটি বোঝা আমাদের জন্য সহজ হয়েছে। এখন অনেকে দামিদামি গাড়িতে আরোহণ করে মসজিদের দরজায় এসে নামে।
অশ্লীল পোশাক স্বাভাবিক হবে
নারীরা পোশাক পরিহিত থাকবে অথচ এর পরও বস্ত্রহীন হবে। আগের যুগে এটি বোঝা অনেক কঠিন ছিল যে পোশাক পরা থেকেও কিভাবে বস্ত্রহীন হয়? কিন্তু আজকে আমরা এটি ঠিকই দেখছি; মেয়েরা এত পাতলা পোশাক পরিধান করে যে দেহের অঙ্গগুলো সবই বাইরে থেকে দেখা যায়।
মহিলাদের চুল হবে উটের কুঁজের ন্যায়
মহিলাদের চুল হবে উটের কুঁজের ন্যায়। রাসুল (সা.) এ ধরনের নারীদের অভিশাপ করেছেন। আগের যুগের আলেমরা এ হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পেরেশান হতেন যে চুল আবার উটের কুঁজের ন্যায় কিভাবে হয়? কারণ উটের কুঁজ অনেক উঁচু হয়, চুল কিভাবে এত উঁচু হবে? কিন্তু কল্পনাতীত অনেক বিষয়কে আজকের যুগ বাস্তব করে দেখিয়েছে। আজকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মেয়েরা চুলকে ফুঁলিয়ে উঁচু করে বাঁধে।
অপরাপর সম্প্রদায় মুসলমানদের গ্রাস করবে
সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, খাদ্য গ্রহণকারীরা যেভাবে খাবারের পাত্রের চতুর্দিকে একত্র হয়, অচিরেই বিজাতিরা তোমাদের বিরুদ্ধে সেভাবেই একত্র হবে। এক ব্যক্তি বললেন, সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এরূপ হবে? তিনি বললেন, তোমরা বরং সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে; কিন্তু তোমরা হবে প্লাবনের স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের আতঙ্ক দূর করে দিবেন, তিনি তোমাদের অন্তরে ভীরুতা ভরে দিবেন। এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! ‘আল-ওয়াহ্ন’ কি? তিনি বললেন, দুনিয়ার মোহ এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪২৯৭) বর্তমান পৃথিবীর চিত্র তেমনটাই মনে হচ্ছে।
ফিতনার যুগে মুসলমানের করণীয়
আমারা এখন হয়তো সেই যুগেই পদার্পণ করছি। কোথাও কোনো শান্তি নেই। সবাই পাপের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। অনিয়মই হয়ে যাচ্ছে নিয়ম। ধর্মভীরুতা হয়ে যাচ্ছে আনস্মার্টনেস। কঠিন কবিরা গুনাহের কাজগুলো হয়ে যাচ্ছে প্রগতিশীলতা। সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, গিবত সবই এখন আমাদের নিত্যদিনের কাজ। এখন আর আমরা গুনাহকে গুনাহ মনে করতেই রাজি নই। (নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহর নাফরমানি করাই হয়ে উঠছে ফ্যাশন। যার কারণ বিশ্বব্যাপী নেমে এসেছে বিপর্যয়। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে আমাদের আবারও ফিরে যেতে হবে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথে।
এখন আর আমাদের অন্যের দোষ তালাশ করার সময় নেই। এখন উচিত নিজেদের সংশোধন করা। গুনাহ থেকে বিরত থাকা। সর্বদা আল্লাহর দরবারে তাওবা-ইসতেগফার করা। সকল ফিতনা থেকে বেঁচে থাকতে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। ফিতনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বীয় উম্মতদের এমন একটি দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল ফিতানি, মা জহারা মিনহা ওয়া মা বাতানা।’ অর্থ : ‘হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল ফিতনা থেকে পরিত্রাণ চাই।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৭৭৮)
বর্তমান সময়ে ফিতনা থেকে বাঁচতে আমাদের করণীয় হলো, চোখের গুনাহ, অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনা, অন্যকে কষ্ট দেওয়া, অন্যের হক নষ্ট করা, সুদ ও ঘুষের গুনাহ থেকে নিজেকে যথাসাধ্য বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। এ ধরনের অপরাধের ব্যাপারে সর্বদা নিজ পরিবার-পরিজন ও বন্ধু মহলকে সতর্ক করতে হবে।