এই দুইজনের লেখা গণমাধ্যমকে পাঠিয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তাদের লেখাগুলো তুলে ধরা হলো:
এক.
‘মুক্তিযোদ্ধার দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে, ‘আমি রাজাকার’ কী ভয়ানক কথা! এসব শব্দগুলো লিখতে আমারও হাত কাঁপছে। অথচ কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অবলীলায় এ সব উচ্চারিত হচ্ছে স্লোগানে, মিছিলে। এ সব শোনার জন্য কি আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম?
কোথায় গেলেন কবি সুফিয়া কামাল, কবি জসিমউদদীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, কবি শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান স্যার? তারা না হয় মারা গেছেন, কিন্তু সমাজ থেকে কি বিবেকও মরে গেছে?
আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তো এই কোমলমতি আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে পারবো না। আমরা দৃঢ়ভাবে জানি, আমাদের অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সন্তান-সন্ততিও এখন কোটা নেওয়ার জন্য বসে নেই। আমাদের অধিকাংশই এখন সত্তরোর্ধ।
তোমরা যারা আন্দোলন করছ, তাদের কাছে অনুরোধ করছি, কোটা সংক্রান্ত সত্য ঘটনাগুলো জেনে নাও।
৫৩ শতাংশ, ৫৬ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে যাচ্ছে, এটা মোটেই সঠিক নয়। নানা ধরনের কোটা আছে- জেলা কোটা, নারী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা, নৃগোষ্ঠী, অনগ্রসর অঞ্চলের জন্য কোটা ইত্যাদি। এর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কোটা যুক্ত হয়েছে-তাও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এর যৌক্তিকতা নিয়ে আমারও প্রশ্ন আছে, সেটা পরে বলবো।
তোমাদের উদ্যম, উদ্যোগ, সাংগঠনিক একাত্মতা দেখে আমরা মুগ্ধ। আমাদের ষাটের দশকের কথা মনে করিয়ে দেয়। তোমরা দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারবে। এমনকি আমাদের চেয়েও বেশি করতে পারবে। তোমাদের কাছে অনুরোধ করি, আন্দোলনের পাশাপাশি তোমরা আরেকটি কাজ করো। তোমার নিজের পরিবারে খোঁজ নিয়ে দেখ, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে কেমন ছিলেন, কী করেছেন? তুমি খুঁজে পাবে হয় তোমার দাদা অথবা চাচা অথবা মামা-কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধে ছিলেনই। অথবা মিলিটারির ভয়ে নয় মাস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। আর, অস্ত্র নিয়ে যাঁরা যুদ্ধ করেছে শুধু তারাই যে মুক্তিযোদ্ধা তাতো নয়; কিছু রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাদে প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত ছিলেন।
আরেকটা কথা- যত ক্ষোভ, দুঃখ আর হতাশাই থাকুক না কেন ‘আমি রাজাকার’ কথাটি লিখো না। এটা একটা অভিশপ্ত চরিত্র।
তোমরা গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে অবশ্যই নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে খুঁজে পাবে। কারণ, এটা সারা জাতির যুদ্ধ ছিল, জনযুদ্ধ ছিল। তখন আর তোমরা এ ধরনের স্লোগান দিতে পারবে না। তোমাদের গলা কাঁপবে, বুক কাঁপবে।
তোমাদের আশেপাশে-বিশ্ববিদ্যালয়, জেলায় এমনকি গ্রামেও গণকবর, বধ্যভূমি খুঁজে পাবে।
সিলেটের রেমা কেলেঙ্গায় যেখানে তোমরা সাইকেল চালাতে যাও তার পাশেই ফয়েজাবাদ হিলস-এ এক বিশাল বধ্যভূমি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে বধ্যভূমি, রাজশাহীর পুলিশ একাডেমির চারিদিকে বধ্যভূমি। কোথায় নাই এই গণকবর আর বধ্যভূমি?
কাজেই কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধ বা মেধাকে তোমাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিও না। এটা ঠিক নয়।
এ কারণেই আমি অবস্থা বোঝার জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক পাঁচ জন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছি।
সবাইকেই লিখিত, ভাইভা দিয়ে যেতে হয়, তারপর কোটার প্রশ্ন আসে। তাঁরা সবাই এমনও বলেছেন যে, অনেক সময় কোটা থাকার পরও তা দেওয়া যায়নি, কারণ এরা মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসতে পারনি।
তবে কিছু অনিয়ম বা ব্যতিক্রম যে হয়নি তা নয়। আর আমাদের বড় বড় জাতীয় দৈনিকগুলো সেই ব্যতিক্রমকেই উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেছে। সত্যটা তুলে ধরলে হয়তো এত বিক্ষোভ জমা হতো না।
সরকারের কাছে আমাদের আর্জি, সম্মান দিতে গিয়ে আমাদের এভাবে অপমান করাবেন না। ভাতা, চিকিৎসাসহ নানা সুযোগ সুবিধা, মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান, কবরস্থান- অনেক কিছুই করা হয়েছে; যা অভাবনীয়। আমরা আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ।
তবে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে কোটা সুবিধা না রেখে, বরং তারা যেন মুক্তিযুদ্ধকে জানে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করে সেই ব্যবস্থা করাটা বেশি জরুরি।
আমাদের জাতীয় সংবিধানে কোটার বিধান আছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের জন্য। আজ অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অনগ্রসরতা দূর হয়েছে। সেই বিবেচনায় কোটা নীতির যথাযথ ও বাস্তবসম্মত সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন।
কিন্তু, কোটার ইস্যুকে কেন্দ্র করে সমগ্র তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া কারও জন্যই কাম্য নয়।
মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার শক্তি যারা, তারা ওত পেতে থাকে এ ধরনের সুযোগের অপেক্ষায়। তারা এ সব পরিস্থিতির সুযোগ নেয়।
আমরা যারা স্বাধীনতা এনেছি, তারা আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে প্রায় সবাই চিরবিদায় নেবো।
তোমাদের হাতে গড়ে উঠবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
তাই সরকারের কাছে আহ্বান কোটা প্রথাকে সময়োপযোগী, যথাযথ ও বাস্তব সম্মত সংস্কার করুন।
আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান-স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করো না, অপমান করো না। তাঁরা তোমাদের প্রতিপক্ষ নয়। তাঁরাই তোমাদের জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। তোমরা স্বাধীনতার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধর।
জয় বাংলা !!!
দুই.
এন রবিবার গিয়ে রাত ২টা। একজন অত্যন্ত প্রবীণ সাংবাদিক ফোন করে জানালেন, এই গভীর রাতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষার্থী মিছিল করছে। তাদের বিভিন্ন স্লোগানের মধ্যে আছে ‘তুমি কে’ ‘রাজাকার’, ‘আমি কে’ ‘রাজাকার’। কয়েকদিন আগে ‘আমি রাজাকার’ লিখে কয়েক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে কোটাবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। আরও কিছু শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিয়েছে, যা আমি এখানে লিখতে পারছি না। অক্ষম অসহায় ক্রোধে আমার শরীর কাঁপছে।
কোটা আন্দোলনে যারা অংশ নিচ্ছে তারা আমাদেরই সন্তানসম। তাদের কোটা সংস্কারের দাবির প্রতি আমার সহানুভূতির কমতি নেই। যদিও তাদের চাওয়া সংস্কারের রূপটি তারা বিশদভাবে বললে আমার মতো একাত্তর দেখা বয়স্ক মানুষদের বোঝতে আরও সুবিধা হতো। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন ডেকেছে, তখন তাদের বক্তব্য বা চাওয়াটুকু বিশদভাবে সেখানে গিয়ে বলতে অসুবিধাটা ঠিক কোথায় বোঝতে পারছি না। তারা নাকি আদালতে যাবে না। আজ আরও অবাক হয়েছি যখন তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও মাত্র ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। একের পর এক এসব ধৃষ্টতা কেন দেখাতে হবে?
নানা ধরনের লোকজন কোটাবিরোধী আন্দোলনে আছে বলে মনে হয়। বিএনপি আর জামাতের নেতারা নাকি সারা দেশ থেকে তাদের ছাত্রদের বলেছে ঢাকায় এসে মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিতে। কিছু শিবির নেতার চেহারা তো টিভি ক্যামেরা আর পত্রিকার পাতায় সাধারণ ছাত্রদের ভীড়ে অহরহ দেখাই যাচ্ছে। পেছনে আরও কারা কারা আছে কে জানে।
তাদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যে অত্যন্ত অপমানজনক স্লোগানগুলো নির্বিবাদে দিচ্ছে তারা কারা? তাদের তো রাষ্ট্রবিরোধী এসব স্লোগানের জন্য কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু অন্য যারা তাদের আশেপাশে আছে, এসব স্লোগান শুনছে, তারাও কেন এদের বাধা দিচ্ছে না? যারা জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধে গেল, জীবন দিল, কেউ কেউ ফিরে এলো— তাঁদের আজ অপমান আর গালি শুনতে হবে। আমাদের এই দেশে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের চাইতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেশি। যারা আজ আত্মস্বীকৃত রাজাকার-সন্তান, তারা আজ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের গালি দেবে প্রকাশ্যে? আর যারা সচেতন শিক্ষিত মার্জিত বাঙালি, যাদের দেশপ্রেম আছে, যারা দেশটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, যাদের আমরা দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হিসেবে দেখতে চাই, যাদের হাতে আমরা আমাদের সন্তানদের রেখে যেতে চাই — তারাও এই নব্য স্বঘোষিত রাজাকারদের কেন কিছু বলছে না? এটাও আমাদের দেখে যেতে হবে? জাতি হিসেবে আমরা কী এতই অকৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম? এই দুঃখ আর লজ্জা কোথায় রাখি!