নিউজ ডেস্ক:
দেশের আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণের সিংহভাগই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর। এসব ব্যাংক থেকে বিতরণকৃত বড় অঙ্কের ঋণ আদায়ে অনেকটা স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। এ কারণে দেশে সত্যিকারের বিনিয়োগকারীরা ঋণ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সাল শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৪৮ শতাংশই দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণধারীদের। কিন্তু নানা কারণে এসব ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে সময় মতো ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। সরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত সোনালী ব্যাংকের ২০১৫ সালে শ্রেণিকৃত ঋণের হার ছিল মোট ঋণের ২৯ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৩১ শতাংশ। এবং চলতি ২০১৭ সালের পর্যন্ত এই হার আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ।
অন্যদিকে জনতা ব্যাংকের ২০১৫ সালে শ্রেণিকৃত ঋণের হার ছিল ১৩ শতাংশ, ২০১৬ সালে দুই শতাংশ কমে হয় ১১ শতাংশ, কিন্তু চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তা আবারও বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকে এই হার ২০১৫ সালে ২২ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২৫ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ২০ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকে ২০১৫ সালে ১৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৭ শতাংশ এবং এবং ২০১৭ সালে ২৭ শতাংশ। বেসিক ব্যাংকে ২০১৫ সালে ৫১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৫৪ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ৫৩ শতাংশ। বিডিবিএল’এ ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ৫০ এবং ২০১৭ সালে ৫২ শতাংশ। এসব শ্রেণিকৃত ঋণের মধ্যে সিংহভাহ রয়েছে বড় বড় ঋণ গ্রাহকদের হাতে।
বিআইবিএমের ‘ক্রেডিট অপারেশনস অব ব্যাংকস-২০১৬’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মাত্র ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ গ্রাহকের কাছে ঋণ দিয়েছে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন এমন গ্রাহকদের কাছে ১৭ শতাংশ এবং ১ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন এমন গ্রাহকদের কাছে ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ ঋণ দিয়েছে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। তবে ব্যাংকগুলোর ৪৭ দশমিক ৯২ শতাংশ ঋণ রয়েছে ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহকদের কাছে।
দেখে গেছে, সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালীর মোট বিতরণকৃত ঋণের ৭০ শতাংশই রয়েছে মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে। ২০১৬ সাল শেষে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকটির পাওনা ছিল ১৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে, এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির শীর্ষ ১২ গ্রাহকের মধ্যে আটটি সরকারি ও চারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই ঋণের অধিকাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। এর বাইরে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ। ফলে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক জনতারও অবস্থাও সোনালী ব্যাংকের মত। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে শীর্ষ ১২ গ্রাহকের কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। যদিও একই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ছিল ৩৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। জুন শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ ১৩ গ্রাহকের কাছে ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১১২ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
একই অবস্থা রূপালী ব্যাংকেও। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ১৭ জন শীর্ষ গ্রাহকের কাছে ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে মোট ১৬ হাজার ৮৮১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকটি। জুন শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা।
বড় গ্রাহকের ঋণ দিয়ে আরো বেকায়দায় আছে কাছে বেসিক, বিডিবিএল ও কৃষি ব্যাংক। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। বিডিবিএল’র ৭৬০ কোটি টাকা। একই সময়ে বিকেবি’র শ্রেণিকৃত ৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এবং রাকাবের ছিল এক হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ পদ্ধতির মাধ্যই ঋণগ্রহীতাদের ঋণ খেলাপি হতে উৎসাহিত করা হয়। ব্যাংকগুলোর একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পরিচালনা পর্ষদের যোগসাজসেই ঋণগ্রহীতারা ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর তা আর ফেরত দিচ্ছে না। এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি আজ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।