নিউজ ডেস্ক:বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আলোচিত আবরার ফাহাদ রাব্বী হত্যা মামলার রায় রোববার ঘোষণার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। গত ১৪ নভেম্বর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য এদিন ধার্য করেন।
হত্যাকাণ্ডের দুই বছর দুই মাস পর এ মামলার রায় হতে চলেছে। আর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চায় আবরারের পরিবার। রোববার রায় ঘোষণার সময় নিহত আবরারের পরিবারের সদস্যরা আদালতে উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।
আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে, তাদের সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দেয়া হোক। এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ড যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে এবং আমার মতো আর কোনো বাবার বুক যেন খালি না হয়। অপরাধ করে কেউ যেন পার না পায়। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন, এটাই রায়ে প্রমাণ হোক।’
আবরারের মা রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘আবরারকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে ওরা। আমরা আবরারকে তো আর ফিরে পাব না। সব খুনির দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হলে কিছুটা শান্তি পাব। আমার ছেলের আত্মাও শান্তি পাবে। ওদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে।’
আবরার ফাহাদের ছোট ভাই ফাইয়াজ বলেন, ‘ভাইকে হারিয়ে আজ আমরা নিঃস্ব। ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচারে সবার ফাঁসি চাই।’
পরিবারের পাশাপাশি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছে। আসামিপক্ষ বলছে, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কাজেই তারা খালাস পাবেন।
রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ২৫ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন। রাষ্ট্রপক্ষের অপর প্রসিকিউটর প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, আবরার হত্যা মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ২৫ জন আসামির বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। রায়ে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করেন তিনি।
প্রেক্ষাপট: ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন আবরার ফাহাদ রাব্বী। এর জেরে পরদিন ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। তারা আবরারের ১০১১ নম্বর কক্ষে গিয়ে রাতে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তার ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইলসহ ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। এরপর ওই কক্ষে আবরারকে নির্যাতন করা হয়। পরে রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
ঘটনার পরদিন ৭ অক্টোবর রাজধানীর চকবাজার থানায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়। পরে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মাঠে নামেন শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।
মামলার একমাস ছয়দিন পর ১৩ নভেম্বর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন। ২৫ জন আসামির মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ১৯ জন। এর বাইরে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আরও ৬ জনের জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, পরস্পর যোগসাজশে ছাত্রশিবির সন্দেহে আবরারকে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগে আরও বলা হয়, তারা একই উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে আবরারকে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, লাথি মেরে, কনুই দিয়ে পিঠে আঘাত করে, ক্রিকেট স্টাম্প ও স্কিপিং রোপ দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আসামি এস এম মাহমুদ সেতুর বিরুদ্ধে ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে একই উদ্দেশ্যে আবরারকে হত্যার জন্য হুকুম দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোড আইনের ৩০২/১০৯/১১৪/৩৪ ধারায় চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আদালত। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
মোট আসামির মধ্যে ২২ আসামিকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন। পলাতক রয়েছেন তিন জন। সবাই বুয়েট ছাত্রলীগ কর্মী। বিচার চলাকালে ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। ২১টি আলামত ও ৮টি জব্দ তালিকা আদালতে জমা দেয়া হয়েছে।
এজাহারে থাকা আসামিরা হলেন-মেহেদী হাসান রাসেল, অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মেহেদী হাসান রবিন, মেফতাহুল ইসলাম জিওন, মুনতাসির আলম জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মুজাহিদুর রহমান, মুহতাসিম ফুয়াদ, মনিরুজ্জামান মনির, আকাশ হোসেন, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মাজেদুল ইসলাম, শামীম বিল্লাহ, মোয়াজ আবু হুরায়রা, এএসএম নাজমুস সাদাত, মোর্শেদুজ্জামান জিসান ও এহতেশামুল রাব্বি তানিম।
এজাহার বহির্ভুত ৬ আসামি হলেন-ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, অমিত সাহা, মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত, এসএম মাহমুদ সেতু ও মোস্তবা রাফিদ। পলাতক তিন আসামি হলেন মোর্শেদুজ্জামান জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মোস্তবা রাফিদ। এদের মধ্যে প্রথম দুইজন এজাহারভুক্ত আসামি। মামলার আট আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গত ১৪ মার্চ আত্মপক্ষ সমর্থনে ২২ আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেন।
গত ৭ সেপ্টেম্বর মামলার অভিযোগপত্রে কিছু ত্রুটি থাকায় রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি পুনরায় চার্জগঠনের আবেদন করেন। পরদিন আদালত ২৫ আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় চার্জ গঠন করে ১৪ সেপ্টেম্বর আত্মপক্ষ শুনানির তারিখ ধার্য করেন। ওই দিন আত্মপক্ষ সমর্থন শেষে দুই কার্যদিবস রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়।