১ লাখ টাকা ঋণের জন্য দিতে হয় ১৫ হাজার!
নিউজ ডেস্ক:বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে মৎস্য চাষ, গরুর খামার, ড্রাগন চাষসহ নানা ধরনের শস্য চাষে কৃষকের ৪% হার সুদে ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষি ঋণ দেওয়ার কথা থাকলেও জীবননগর কৃষি ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ কৃষকদের। শুধু তাই নয়, ঋণ নেওয়ার জন্য ঋণ প্রত্যাশীদের কাছ থেকে প্রতি লাখে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া দালাল চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে কৃষকদের নিকট থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে কৃষি ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে বিষয়টি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন জীবননগর কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার মাহাতাব উদ্দিন।
কৃষি ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী জীবননগর উপজেলায় ইতোমধ্যেই ৯৫ জন সুবিধাভোগীদের মধ্যে ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে ভোটার আইডি কার্ড এবং সামান্যতম জমির কাগজ দিয়ে উপজেলার ১১২ জন কৃষককে কৃষি ঋণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উপজেলায় ৮ জন তরুণ উদ্যোক্তার মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসার জন্য ৩৫ লাখ টাকা কৃষি ঋণ প্রদান করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী কৃষি ঋণ নেওয়ার জন্য আবেদন ফি, সার্স ফি, সিআইবি এবং ১৫% ভ্যাটসহ সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৯০ টাকা জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে কৃষি ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজসে দালাল চক্রের সদস্যরা দ্রুত কৃষি ঋণ করে দেওয়ার নাম করে কৃষকদের নিকট থেকে লাখপ্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
কৃষি ঋণ নিতে আসা উপজেলার সীমান্ত ইউনিয়নের নতুনপাড়া গ্রামের মৃত শুকুর মণ্ডলের ছেলে কৃষক বিশারত আলী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি কৃষি ব্যাংকে ৪ লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার কথা বললে সীমান্ত ইউনিয়ন পরিষদের আমিন এবং আমাদের গ্রামের ছেলে মোস্তফা আমাকে বলে আমি লোন করে দিতে পারি, তবে লাখে ১০ হাজার টাকা খরচ হবে। খরচ না দিলে সারা জীবন ঘুরলেও লোন করতে পারবে না। তার কথা মতো আমি ৪ লাখ টাকা লোনে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। ব্যাংক থেকে আমাকে প্রথমে ২ লাখ টাকা দিয়েছিল আর বাকি ২ লাখ টাকা রোববারে দিয়েছে।’
শুধু মোস্তফা, আমিনই একা নন, কৃষি ব্যাংক জীবননগর শাখার ম্যানেজার মাহাতাব উদ্দিনের ভাইরা-ভাই তেঁতুলিয়া গ্রামের সেকেন্দার আলী, লক্ষীপুর গ্রামের মশিয়ার রহমান, কয়া গ্রামের আমিনুর রহমান, আশতলাপাড়ার শহিদুল ইসলাম, কৃষি ব্যাংকের সামনে চায়ের দোকানদার লক্ষীপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম, সদরপাড়া গ্রামের জয়নাল আবেদীনসহ বেশ কিছু দালাল চক্রের সদস্যরা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষি ব্যাংকের নীচ তলা শাপলা প্লাজার পিছনে কৃষকদের লোন করে দেওয়ার নাম করে এসব অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষি ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার জন্য উপজেলা মৎস্য অফিস, উপজেলা প্রাণিসম্পদ এবং উপজেলা কৃষি অফিস থেকে একটি প্রত্যায়নের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে লোন দেওয়া হয়ে থাকে। তবে আদৌ কি এ নিয়ম মানা হচ্ছে? দালাল চক্রের সদস্য মোস্তফা বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিয়ে লোন করিনি। আমার নামে একটা মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে।’
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, জীবননগর শাখার ব্যবস্থাপক মো. মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংকে কৃষকদের লোন প্রদানে কোনো অর্থ নেওয়া হচ্ছে না। তবে দালালদের কারণে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। ইতোমধ্যেই আমাদের ব্যাংকের কেউ জড়িত আছে কি না, সে বিষয়ে তদন্ত করছি। যদি কেউ জড়িত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কোনো কৃষক যদি বাইরে থেকে দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে থাকে, সেটা তাদের বিষয়। এটা তো আমার বিষয় নয়।’
জীবননগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহা. নুর আলম বলেন, ‘জীবননগর উপজেলায় বেশ কিছু ব্যক্তি নতুন করে গবাদি পশু পালন, মুরগির খামার, গরুর ফার্ম স্থাপনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ব্যাংক থেকে তাদের একটা লোনও দেওয়া হচ্ছে এবং ব্যাংকে লোন নেওয়ার জন্য আমাদের নিকট একটি প্রত্যায়নপত্রের জন্য আসছে। তবে আমরা তদন্ত করেই প্রত্যায়নপত্র দিয়ে থাকি। তবে যদি এ লোন নিয়ে তারা খামার তৈরি করে, তাহলে এ উপজেলায় অনেক বেকার যুবকের কর্মস্থানের ব্যবস্থা হবে।’
জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, ‘কৃষি ব্যাংক থেকে কৃষকদের যে লোন দিচ্ছে, এ বিষয়ে কৃষি ব্যাংক থেকে আমাদের নিকট থেকে উপজেলার কৃষকদের নামের তালিকা নেওয়ার কথা থাকলেও এখনও পর্যন্ত তারা তালিকা নিয়ে যায়নি। তাদের ইচ্ছামতো লোন দিচ্ছে।’
এদিকে, কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং দালালদের এমন কাণ্ড দেখে এলাকার সাধারণ মানুষ হতবাক। কৃষি ব্যাংকে সেবার নামে চলছে একটি বড় ধরণের বাণিজ্য। তাই স্থানীয় সুধী সমাজ এবং প্রান্তিক কৃষকেরা কৃষি ব্যাংকে দালাল মুক্ত করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।