সিরাতুন্নবী বিশাল ও বিস্তৃত একটি বিষয়। তার কারণ এই যে, অপরাপর নবীগণের বিপরীতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী (সা.) কে সর্বশেষ নবী বানিয়ে প্রেরণ করেছেন। সঙ্গে এও বলে দিয়েছেন যে, “তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম নমুনা। ” (সূরা আল আহজাব: ২১) এখানে ব্যাপক শব্দে বলা হয়ে
অতএব তিনি সবার জন্য উত্তম আদর্শ। বাদশাহর জন্য যেমন, তেমনি গরিবের জন্য, সম্পদশালীর জন্য, নিঃস্বের জন্য, বড়র জন্য, বুড়োর জন্য, ব্যবসায়ীর জন্য, শিক্ষার্থীর জন্য। মোটকথা জীবনের সব অঙ্গনে আমাদের জন্য নবীজীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ। নিশ্চয় শিক্ষার্থীদের জন্য এবং কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও তাতে রয়েছে মহান আদর্শ।
কত বিস্ময়ের কথা যে, নিরক্ষর লিখতে জানেন!
এখানে নবী (সা.) এর শিক্ষাজীবন অথবা শিক্ষা বিষয়ে তাঁর দিকনির্দেশনা প্রসঙ্গে কিছু কথা পেশ করা যাচ্ছে। কত বিস্ময়ের কথা যে, একজন নিরক্ষর ব্যক্তি; লেখাপড়ার সঙ্গে যার কোনো পূর্ব সম্পর্ক নেই- ওই তাঁকে ওহির মাধ্যমে সর্বপ্রথম যে হুকুম দেয়া হয়, তা ছিল- পড়! অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ যেগুলো এখনও বিদ্যমান, যেমন: তাওরাত, ইঞ্জিল, আগশতা, ভেদ প্রভৃতিতে জ্ঞান ও শিক্ষার এমন মর্যাদা প্রদান করা হয় নি; যেভাবে কোরআনে করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ওহি ‘পড়’ দিয়ে শুরু হয়। এর পরই, দুতিন বাক্যের পরের আয়াতগুলোতে কলমের প্রশংসা করা হয়েছে।বলা হয়েছে, ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। ‘ (সূরা আলাক: ৪-৫) যদি এই কলম না থাকত তবে আমাদের পূর্বসূরিদের জ্ঞান-বিজ্ঞান সংকলিত হয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছাত না। আমরা ওসব থেকে উপকৃত হতে পারতাম না। জ্ঞানের উন্নতি তখন হতে পারে, যখন পুরাতন তথ্যগুলো সম্পর্কে আমাদের অবগতি থাকে এবং আমরা তাতে সংযোজন করতে পারি। তো ওহির এই প্রথম বিধান নবীজি (সা.) সারাজীবন পালন করেছেন।
আমার ব্যক্তিগত অনুমান এই যে, উপরিউক্ত আদেশ পেয়ে নবীজি লেখালেখি কিছুটা শিখে নিয়েছিলেন। কেননা নবীজি অন্যকে যে হুকুম দিতেন, প্রথমে নিজে তার ওপর আমল করতেন। এমন নয় যে, তিনি অপরকে আদেশ দিবেন আর নিজেকে ওই আদেশের ঊর্ধ্বে মনে করবেন। বস্তুত ওটাই ছিল নবীজির সবসময়ের কর্মপদ্ধতি। আমার এই গবেষণার সূত্র হলো হুদায়বিয়া চুক্তি সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ একটি হাদিস। হুদায়বিয়ায় চুক্তি হয়েছিল মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে। তারপর নবীজি তা লিখিয়েও ছিলেন। হজরত আলী (রা.) কে হুকুম করলেন, লেখ! তিনি লেখার সূচনা এভাবে করেন যে, মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ এবং সুহাইল ইবনে আমরের মাঝে চুক্তি। সুহাইল ইবনে আমর ছিলেন কুরাইশের প্রতিনিধি। তিনি তখন আপত্তি করে বসলেন, না, এমন হতে পারে না। আমরা যদি আপনাকে রাসূলুল্লাহ বা আল্লাহর রাসূল বলে মানতাম তবে তো আপনার সঙ্গে কখনও যুদ্ধে জড়াতাম না। আপনার নাম লিখুন! তো নবীজি (সা.) তড়িৎ হজরত আলী (রা.)কে হুকুম করলেন, মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ মিটিয়ে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ লিখ। হজরত আলি শপথ করে বলে ফেললেন, আল্লাহর শপথ! রাসূলুল্লাহ শব্দটি আমি কখনও মিটিয়ে দিতে পারব না। সহিহ বুখারির বর্ণনায় রয়েছে যে, নবীজি বললেন, আচ্ছা তাহলে ওই কাগজটা আমাকে দাও! তিনি রাসূলুল্লাহ শব্দটি মিটিয়ে দিলেন, সম্ভবত থুথু দিয়ে। সহিহ বোখারিতে শব্দ এসেছে যে, তিনি নিজ হাতে ওই স্থানে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ লিখে দেন। যদিও তিনি খুব ভালো লেখা জানতেন না। এসব বোখারির শব্দ। খুব ভালো না জানা এক বিষয় আর মোটেও লেখা না জানা আলাদা বিষয়। এখান থেকে আমার গবেষণা এই যে, নবীজি (সা.) ‘পড়’-এর হুকুম পালন করেছিলেন এবং কিছু লেখাপড়া শিখে ফেলেছিলেন।
নারী-পুরুষ উভয়ের শিক্ষা তাঁর নিকট সমানভাবে প্রিয় ছিল
ওই হুকুম পালনের দ্বিতীয় যে দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পাই, সেটা মদিনায় হিজরত করার পূর্বের কথা। শিক্ষাগত দৃষ্টিকোণ থেকে তাতেও আমাদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে। ইবনে ইসহাক (রহ.) তদীয় সিরাতগ্রন্থে দুর্লভ একটি বর্ণনা পেশ করেছেন যে, যখনি নবী (সা.) এর নিকট কোনো ওহি আসত, তিনি তৎক্ষণাত তা পুরুষদের মজলিশে পড়ে শোনাতেন। এরপর মহিলাদের মজলিশেও পড়ে শোনাতেন। ভিন্ন শব্দে এভাবে বলা যায় যে, পুরুষদের শিক্ষাদান এবং নারীদের শিক্ষাদান উভয়টাই সমানভাবে তাঁর নিকটি প্রিয় ছিল। শিক্ষাদানে তিনি কোনো ব্যবধান করতেন না। পুরুষদের যা শিখাতেন,নারীদেরও তাই শিখাতেন। ওই সময়কার যে শিক্ষা ছিল অর্থাৎ কোরআন শিক্ষা- সেটা নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝেই পাওয়া যেত।কেউ শিক্ষার এমন মূল্যায়ন করে নি, যেমনটা একজন নিরক্ষর নবী করেছেন
তারপর আমাদের সামনে আরও কয়টি দৃষ্টান্ত উদ্ভাসিত হয়। হিজরত করে নবীজি (সা.) মদিনায় পৌঁছার কিছুদিনের ভেতরেই মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। বদর যুদ্ধ হয় দ্বিতীয় হিজরিতে। এসময়কার অনেক দুর্লভ ও বিরল উপমা আমাদের জানা আছে; যেগুলো দুনিয়ার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তা এই যে, শত্রুপক্ষের ৭০ জন বন্দী হয়। প্রশ্ন ছিল, তাদের কী করা হবে? হজরত ওমর (রা.) তাঁর স্বভাবজাত জজবা থেকে বলে উঠেন, তাদের গর্দান উড়িয়ে দেয়া হোক। না এরা কখনও মুসলমান হবে আর না এদের পরবর্তী প্রজন্ম মুসলমান হওয়ার আশা করা যায়! উল্টো এরা সবসময় আমাদের অযথা কষ্ট দিতেই থাকবে। তবে হযরত উমার রাযি. যেহেতু একজন বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন, তাই আরেকটি বাক্য তিনি যোগ করলেন। বললেন, এদের প্রত্যেককে হত্যার জন্য তার স্বগোত্রীয় একজন মুসলমানকে দায়িত্ব প্রদান করা হবে। এতে করে বংশীয় যে টান ও জ্বলন আছে, হত্যার কারণে পরবর্তীতে মুসলমানদের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির আশংকা থেকে মুক্ত থাকা যায়। অন্যদিকে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মনে হয়, হত্যার পরিবর্তে তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হোক যা ইসলামের জন্য মঙ্গলজনক হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং তাদের থেকে মুক্তিপণ আদায় করা যেতে পারে। মেনে নিলাম, তারা হয়তো বা মুসলমান নাই হলো। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম মুসলমান হওয়ার তো সম্ভাবনা রয়েছে। মুক্তিপণের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। জনপ্রতি ৪ হাজার দিরহাম করে দিতে হয়েছিল।তো যারা সম্পদশালী ছিল, তারা মুক্তিপণ প্রদান করেছে। যাদের আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব ধনী ছিল তারা ওদের থেকে ধার করে অথবা ভিন্ন কোনো উপায়ে নিজেদের মুক্তিপণ দিয়েছে। কিন্তু বন্দীদের মাঝে এমনও কিছু লোক ছিল, যাদের কিছুই ছিল না। রাসূল (সা.) তাদের ব্যাপারে আদেশ করলেন- সেই বিষয়টাই এ আলোচনার প্রতিপাদ্য। যেসব বন্দী লেখাপড়া জানত তাদের বলা হলো, প্রত্যক বন্দী যেন দশ দশজন মানুষকে লেখাপড়া শিখায়। ফলে এ কাজ করতে পারলে তাদের ৪ হাজারের সেই বড় অংকের দিরহাম গুনতে হবে না। বরং তাদের বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেয়া হবে। এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় আরেকটি পাওয়া যাবে না যে, বিজয়ী সেনাপতিরা কখনও এভাবে শিক্ষার মূল্যায়ন করেছেন। না সিকন্দর, না বেলু সলর আর না হিটলার। কেউ জ্ঞান ও শিক্ষার এমন মূল্যায়ন করে নি, যেমনটা একজন নিরক্ষর নবী করেছেন! এরকম বেশুমার দৃষ্টান্ত আমরা নবীজীবনে দেখতে পাই।
সিন্ধু ইউনিভার্সিটিতে ড. মুহাম্মাদ হামিদুল্লাহ (রহ.) প্রদত্ত একটি ভাষণের সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুয আহমদ