হাবিবুল ইসলাম হাবিব, টেকনাফ: মিয়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারনে এখন নানা ধরণের সমস্যায় পড়েছেন উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় লোকজন। পর্যটন মৌসুমেও টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল এবং প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে গত দু’মাস ধরে সাগর ও নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। একই কারণে পর্যটন শিল্প নির্ভর দ্বীপ সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা ও টেকনাফ উপকূলের জেলেরা গত দু’মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা একবেলা খাবার পেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। চরম বেকায়দায় পড়েছেন পর্যটন শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় মাঝি-মাল্লাসহ মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে গত দু’মাস ধরে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। জাহাজ চলাচল শুরু করতে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক বসে আগামী ১০ নভেম্বর জাহাজ চলাচলের সিদ্ধান্ত হলেও কবে নাগাদ চালু হবে স্থানীয় দ্বীপবাসী জানেনা।
সুত্রে জানা যায়, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন নৌপথের দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী নাফ নদী হয়ে যেতে হয় প্রায় ২৪ নটিক্যাল মাইল। সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় ১০ নটিক্যাল মাইল। নাফ নদীর অংশ পার হওয়ার সময় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপি একাধিকবার বাংলাদেশি নৌযানে গুলি চালায়। এ পরিস্থিতিতে মাছ ধরার ট্রলারের পাশাপাশি যাত্রী ও পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়। এবং ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে দু’মাস ধরে। এতে করে এ মৌসুমে দেশি প্রায় ১০ লাখ পর্যটক বাইরের দেশে চলে যাবেন। ইতোমধ্যেই অনেক পর্যটক বাইরে চলে গেছেন। এছাড়া, জাহাজ চলাচল না করায় ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন অনিশ্চতার মধ্যে।’ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন ভিত্তিক পর্যটন শিল্পে।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর অক্টোবরের শুরু থেকে পরের বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার।
স্থানীয় বিজিবি সুত্র জানায়, ইয়াবা চোরাচালান রোধে প্রশাসনের নির্দেশে অক্টোবর মাস এ অঞ্চলে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। এর আগে ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করলে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়।
শাহপরীর দ্বীপের জেলে মুফিজুর রহমান জানান, মাছ ধরতে যেতে পারলে ঘরের চুলায় আগুন জ্বলে, না পারলে খাওয়া জোটে না। প্রায় দু’মাস সাগরে যেতে পারছি না। চোখের সামনে স্ত্রী-সন্তানকে উপবাস করতে দেখার যন্ত্রণা আর সইতে পারি না।
মুফিজ জানান, তার বাপ-দাদা জেলে ছিল। তাই তিনিও এ পেশায় এসেছেন। দু’বছর আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে তার বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয়।
মাছ ব্যবসায়ী ও নৌকার মালিক নুর মোহাম্মদ বলেন, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘাটে তিন শতাধিক ট্রলার ও নৌকা আছে। এসব ট্রলার ও নৌকাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের সংসার চলত। কিন্তু দু’মাস ধরে সাগর ও নাফ নদীতে মাছ ধরতে না দেয়ায় তাদের সংসারে দুর্দিন যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সব জেলেরা চোরাচালানে জড়িত নয়। যারা জড়িত, তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের মাছ শিকারে যেতে দেয়ার দাবি জানান তিনি।
সেন্টমার্টিনের জেলে আবদুল সালাম জানান, ভরা মৌসুমে সাগরে নামতে না পারায় সব জেলে পরিবারে দেখা দিয়েছে অভাব-অনটন। ঘরে চাল-ডালের মজুদ শেষ। দু’দিন ধরে ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার দিতে পারেননি তিনি।
শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রিপাড়ার জেলে পরিবারের গৃহবধূ মরিয়ম বেগম বলেন, পরিবারের সাত সদস্যের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।
টেকনাফ পৌরসভার দক্ষিণ জালিয়া পাড়ার জেলে জাফর আলম বলেন, দু’মাস ধরে ঘাটে বেঁধে রাখায় ট্রলারের নিচের তক্তা পচে গেছে। পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে ইঞ্জিন। এখন ২০ হাজার টাকা খরচ করে ইঞ্জিন মেরামত করতে হবে।
সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নূর হোসেন বলেন, মিয়ানমার থেকে নাফনদীর সীমান্তে রোহিঙ্গার ঢল নামায় তাৎক্ষণিকভাবে নাফ নদে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, নাফনদীতে মাছ ধরা নামে অনেকে জেলের বেশে নৌকায় ইয়াবা পাচার করে থাকে। চোরাচালান প্রতিরোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সাগর ও নাফ নদে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, মিয়ানমার থেকে যে সব রোহিঙ্গা আসছে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও মানবিক সহায়তা দিয়ে ক্যাম্পে পাঠাতে সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হচ্ছে।