নিউজ ডেস্ক:
অন্য সব পেশা উদ্ভবের আগেই ব্যবসা ছিল আদি মানুষের পণ্য বিনিময়ের একটি মাধ্যম। এক পণ্যের বিনিময়ে অন্য পণ্য দিয়েই মূলত ব্যবসার সূত্রপাত। তবে মুদ্রা আবিষ্কারের পরেই ব্যবসার ধরন বদলে যায় এবং ব্যবসাকে কেন্দ্র করে মানবসভ্যতাও বদলে যায়। ব্যবসাও বদলাতে থাকে তবে বদলায়নি ব্যবসার উদ্দেশ্য। ব্যবসার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, পণ্য বা সেবার বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করা। তবে সেই পণ্য এবং সেবা অবশ্যই হতে হবে মূল্যের বিপরীতে সমান বা সমতুল্য। ওজনে সঠিক পরিমাণে দেয়া বা পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখা বা পণ্যের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি না রাখা ইত্যাদিই হচ্ছে সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি ভোক্তার অধিকার। ভোক্তার যেগুলো অধিকার, বিক্রেতা বা সেবাদাতার জন্য সেগুলো দায়িত্ব বা কর্তব্য।
তবে ব্যবসা যেহেতু মানুষের দ্বারা পরিচালিত, সেহেতু মানুষের আচরণ-প্রকৃতি সবই ব্যবসার ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই অন্যসব পেশার মতো ব্যবসাতেও দুষ্টু মানুষের খারাপ অভিপ্রায়গুলো কিছু ক্ষতিকর দিক তৈরি করছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো তৈরি করে যাবে। আর ওসব ক্ষতিকর দিকগুলো সব ভোক্তাদের বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে যা অমানবিক এবং বেআইনি। যখনই বেআইনি কাজের প্রশ্ন ওঠে, তখন আইনও চলে আসে নির্দ্বিধায়। ভোক্তাদের ঠকানো সবসময়ই অমানবিক এবং অনৈতিক কাজ। কিন্তু অমানবিক এবং অনৈতিক বললে সেখানে কঠোরতার বিষয়টা আসে। তাই নিয়ে আসতে হয় আইন, তখন আইন অমান্য বা আইনের বিরোধিতাই হচ্ছে বেআইনি, আর বেআইনি কাজের বিরুদ্ধেই আছে কঠোরতা, আছে শাস্তির ব্যবস্থাও।
বাংলাদেশে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯’ নামের একটি আইন রয়েছে যেটি ভোক্তাদের সব অধিকার নিয়ে কাজ করে। আইনটি যেমন একদিকে নিশ্চিত করে বিক্রেতা বা সেবাদাতাদের দায়িত্ব, অন্যদিকে নিশ্চিত করে ভোক্তাদের অধিকার। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অবলম্বনে বিক্রেতা বা সেবাদাতার কী কী দায়িত্ব রয়েছে এবং দায়িত্ব অবহেলায় কী কী শাস্তি রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুসারে একজন বিক্রেতা বা সেবাদাতার যে দায়িত্বগুলো রয়েছে তা হলো : ১. পণ্য মোড়ক দিয়ে আবদ্ধ অবস্থায় বিক্রি করতে হবে এবং মোড়কে ওই পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, প্যাকেটজাতকরণের তারিখ এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। অন্যথায় শাস্তি, অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ- হতে পারে। ২. দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্যের মূল্যের বা সেবার মূল্যের তালিকা প্রদর্শন করতে হবে। না প্রদর্শন করলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ৩. নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব করা যাবে না। করলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ৪. কোনো ব্যক্তি জেনেশুনে ভেজালমিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব করবে না। করলেই শাস্তি_ অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদ-, বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ৫. কোনো ব্যক্তি মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য যা আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে মেশাবেন না। এরকমটি করলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদ-, বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ৬. কোনো ব্যক্তি মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য যা আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করবেন না। করলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাদ-, বা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ৭. কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রির উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা যাবে না। করলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ৮. প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ করবেন। না করলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ৯. কোনো পণ্য সরবরাহ বা বিক্রির সময় ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজনের চেয়ে কম ওজনে ওই পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করবেন না। করলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ১০. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তির দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজনের চেয়ে অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন থেকে বিরত থাকবেন। বিরত না থাকলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ১১. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তির দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত গজ বা ফিতা প্রকৃত দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অধিক দৈর্ঘ্য প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিরত না থাকলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ১২. কোনো পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন করা থেকে বিরত থাকবেন। অন্যথায় শাস্তি_ অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদ-, বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ১৩. মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রয় করবেন না বা বিক্রির প্রস্তাব করবেন না। করলে শাস্তি_ অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ১৪. কোনো ব্যক্তি, কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত বিধি-নিষেধ অমান্য করে সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে এমন কোনো কাজ করবেন না। করলে শাস্তি হিসেবে রয়েছে_ অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদ-, বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। ১৫. কোনো সেবা প্রদানকারীর অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দ্বারা সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটে এমন কোনো কাজ করবেন না। করলে শাস্তি হিসেবে আছে_ অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদ-, বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-।
তবে যদি কোনো বিক্রেতা বা সেবাদাতা উপরোলি্লখিত কোনো অপরাধের জন্য দ-িত হয়েও আবার একই অপরাধ করেন তবে তিনি ওই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যে দ- উল্লেখ আছে, তার দ্বিগুণ দ-ে দ-িত হবেন। অর্থাৎ যদি কেউ নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করে ইতোমধ্যে একবার শাস্তি ভোগ করেছে যা ছিল অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-। কিন্তু তিনি যদি এই একই অপরাধ আবার করে বসেন তখন তার শাস্তি আর অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদ-, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- হবে না, বরং তা দুই বছর কারাদ- বা এক লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- হতে পারে।
মোটামুটিভাবে এই দায়িত্বগুলোকেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। আশা করি, বিক্রেতা বা সেবাদাতারা ওই দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করবেন।