প্রথমবার ইভিএম ব্যবহার : প্রথম ভোট দেবেন নতুন ১ কোটি ২৩ লাখ ভোটার

0
53

সংসদ নির্বাচন: কাল প্রচার-প্রচারণা শেষ
উৎসবের পাশাপাশি চলছে সংঘাত-সংঘর্ষ : নির্বাচন ঘিরে অন্তহীন অভিযোগ
নিউজ ডেস্ক:একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব ধরনের প্রচার ও সভা-সমাবেশ কাল শুক্রবার শেষ হচ্ছে। এদিন সকাল ৮টার পর থেকে কোনো প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল প্রচার কার্যক্রম চালাতে পারবেন না। নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও) অনুযায়ী, ভোট গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগ থেকে সব ধরনের প্রচার বন্ধ থাকার বিধান রয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ২৯৯টি আসনে টানা ভোটগ্রহণ চলবে। এরপরই ফল প্রকাশ করা হবে।
প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে গাইবান্ধা-৩ আসনে ভোট গ্রহণ পিছিয়ে গেছে। এ নির্বাচনের ফলে নির্ধারিত হবে আগামী দিনে কোন রাজনৈতিক দল বা জোট সরকার গঠন করবে। এদিন ভোট দেয়ার সুবিধার্থে সারা দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ নির্বাচনে নতুন প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ ভোটার প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবেন। এ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন আসনে সহিংস ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক নেতাকর্মী।
এদিকে ১০ বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি হয়েছে। এবার নিবন্ধিত সব (৩৯টি) রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৮০০’র বেশি প্রার্থী। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী প্রায় ১ হাজার ৭৫০ জন। বাকিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী অংশ নেয়ায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল বর্জন করেছিল।
এবার সব দল অংশ নেয়ায় সারা দেশে নির্বাচনী আবহ বিরাজ করছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের বিস্তর অভিযোগ করেছে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির। একই অভিযোগ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, বাম রাজনৈতিক মোর্চাসহ আরও কয়েকটি দল। ফলে এবারের ভোট ঘিরে উৎসবের পাশাপাশি শঙ্কাও বিরাজ করছে। বিএনপি, ২০ দলীয় জোটের শরিক ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশনে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবার ৩০০ আসনে ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার। এতে ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোট কেন্দ্র ও ২ লাখ ৬ হাজার ৪৭৭টি ভোটকক্ষ রয়েছে। এবারই প্রথম ছয়টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হবে। যদিও এ মেশিন ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ভোটগ্রহণ কাজে নিয়োজিত থাকবেন প্রায় সাত লাখ কর্মকর্তা। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছয় লাখের বেশি সদস্য।
এরই মধ্যে সেনা ও নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশসহ (বিজিবি) অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নেমেছেন। এছাড়া সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা মনিটরিংয়ে কাল শুক্রবার ইসিতে ‘আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় ও মনিটরিং’ কমিটি কার্যক্রম শুরু করবে। ২৮ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে সারা দেশে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধিনিষেধ এবং ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে সড়ক ও নৌপথের যানচলাচল বন্ধ থাকবে।
নির্বাচনে প্রচার শেষ হচ্ছে শুক্রবার : ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। আরপিও অনুযায়ী, ভোট গ্রহণ শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে কোনো ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রচার করতে পারবেন না। আরপিওর ৭৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, ভোট শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে এবং ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর কোনো ব্যক্তি, প্রার্থী বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কেউ নির্বাচনী এলাকায় কোনো ধরনের সভা, সমাবেশ আয়োজন বা এতে যোগ দিতে পারবেন না। সে অনুযায়ী, ২৮ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে পহেলা জানুয়ারি বিকাল ৪টা পর্যন্ত যে কোনো ধরনের সভা, সমাবেশ ও মিছিল এবং শোভাযাত্রা করা যাবে না। ইসির এক কর্মকর্তা জানান, প্রচার-প্রচারণা শেষ হওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে প্রচার করা হবে। যাতে রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও ভোটাররা সচেতন হতে পারেন। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ সময়সীমা সংক্রান্ত বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যাতে কেউ এ বিধান লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নিতে পারেন।
নির্বাচন ঘিরে অন্তহীন অভিযোগ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, প্রচারে বাধার পাঁচ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। এর মধ্যে বেশির ভাগই বিএনপির ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের। এছাড়া আওয়ামী লীগ, ১৪ দলীয় জোট, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দলও একই অভিযোগ করেছেন। নির্বাচন ঘিরে কয়েকটি জেলায় হামলার শিকার হয়েছেন বলে বুধবার কমিশনে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারাও। এ নির্বাচন ভ-ুল করার মতো গুরুতর অভিযোগ একে অপরের বিরুদ্ধে তুলেছেন বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, এসব অভিযোগের বেশির ভাগই পুলিশ ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে ‘আইনানুগ ব্যবস্থা’ নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে কমিশন। এ পর্যন্ত প্রশাসন ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিজ কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া অর্ধশতাধিক অভিযোগ তদন্ত করার জন্য নির্বাচন তদন্ত কমিটির কাছে পাঠিয়েছে ইসি। এর মধ্যে বেশির ভাগ অভিযোগের সত্যতা পায়নি বলে জানিয়েছে কমিটিগুলো।
নির্বাচনী মাঠে সেনা, বিজিবি ও অন্যান্য বাহিনী : ইসি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা দেশে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর থেকে দেশের ৩৮৯টি উপজেলায় সেনা ও ১৮ জেলায় নৌবাহিনীর সদস্য মাঠে নেমেছেন। তারা ভোটের পর ২ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, ২০ ডিসেম্বর থেকে বিজিবি ও কোস্টগার্ড মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। বুধবার সারা দেশে র‌্যাব ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যরাও মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে নামেন। তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, এবারের নির্বাচনে মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরের সাধারণ কেন্দ্রগুলোয় ১৪ থেকে ১৫ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৬ জন সদস্য মোতায়েন থাকবেন। মেট্রোপলিটন এলাকার কেন্দ্রগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ওই সংখ্যা থেকে ১ জন করে বেশি রাখা হবে। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল, হাওর এলাকার কেন্দ্রগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসংখ্যা আরও বেশি থাকবে। ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে মোতায়েন করা হবে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদা ১৯৩৭, পেয়েছে ৬৭৬ জন : ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবার নির্বাচনে আচরণবিধি প্রতিপালনে মাঠপর্যায়ে ১ হাজার ২০০ জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও পুলিশের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং টিমের সঙ্গে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট দেয়ার জন্য অতিরিক্ত ১ হাজার ৯৩৭ জনের চাহিদা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল ইসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬৭৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, চাহিদা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের একাধিক টিম একসঙ্গে টহল দেবে। একসঙ্গে তারা অ্যাকশনে যাবে। তিনি জানান, চাহিদা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া গেলে প্রতিটি টিম আলাদাভাবে অ্যাকশনে যেতে পারত।
প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার : এবার প্রথমবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হবে। আসনগুলো হচ্ছে- ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ এবং সাতক্ষীরা-২ আসন। এসব আসনের ৮৪৫টি কেন্দ্রের ৫ হাজার ৩৮ ভোটকক্ষে এ মেশিন ব্যবহার করা হবে। এ ছয়টি আসনে ভোটার সংখ্যা ২১ লাখ ২২ হাজার। আজ বৃহস্পতিবার এসব আসনে মক ভোটিং অনুষ্ঠিত হবে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, আঙুলের ছাপ, ভোটার নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর বা স্মার্ট পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভোটার শনাক্ত করে ভোট গ্রহণ করা হবে এ মেশিনে। এতে ভোটার পছন্দের প্রার্থী ও প্রতীক দেখে বাঁ দিকের বোতামে চাপ দিয়ে সিলেক্ট করবেন। ওই ব্যালট ইউনিটে সবুজ রঙের ঈঙঘঋওজগ বাটনে চাপ দিলে তার ভোট দেয়া হয়ে যাবে। কখনও ভুল প্রতীক সিলেক্ট করা হলে, ব্যালট ইউনিটের লাল রঙের ঈঅঘঈঊখ বাটন চেপে পরে যে কোনো প্রার্থীকে আবার সিলেক্ট করা যাবে। এভাবে দুইবার ঈঅঘঈঊখ করা যাবে, তৃতীয়বার যেটি সিলেক্ট করা হবে, সেটি বৈধ ভোট হিসেবে গৃহীত হবে।