নিউজ ডেস্ক:
কৃষিঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খেলাপি ঋণ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমানত ও সুদের হারে। আর যদিওবা কিছু কিছু ঋণ পরিশোধ হচ্ছে, তার গতি অত্যন্ত শ্লথ। খেলাপি ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষি খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চলমান খেলাপির পরিমাণ চার হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে কৃষিঋণের খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৮ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা প্রকৃত কৃষক তারা অনিয়ম-দুর্নীতি করে না। ঋণ খেলাপিতে তাদের দোষ নেই। বরং কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী যোগসাজশ করে কৃষকদের ফাঁসায়। এছাড়া কৃষিঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ইতিবাচকভাবেও দেখছেন না তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোর তৎপরতা এবং ব্যাংকগুলোর উদ্যোগের কারণে কৃষিঋণ ও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ বাড়ছে এবং বড় বড় কোল্ড স্টোরেজে ঋণ দেওয়া হচ্ছে কৃষিঋণের নামে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। তবে এগুলোকে বন্ধ করতে গিয়ে প্রকৃত কৃষকদের ঋণ বিতরণ করা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। প্রকৃত কৃষকদের ঋণ দিতে হবে।
এছাড়াও নানা ধরনের অসুবিধার কারণে প্রকৃত কৃষকদের অনেকে ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
চলতি অর্থবছরে ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) দুই হাজার ৭৯৪ কোটি পাঁচ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে দেশের ব্যাংকগুলো, যা লক্ষ্যমাত্রার ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের দুই মাসে বিতরণ করা দুই হাজার ৭৯৪ কোটি পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৮০৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এছাড়া বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে এক হাজার ৯৮৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
কৃষিঋণ বিতরণে শীর্ষে রয়েছে সরকারি খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বিশেষায়িত এই ব্যাংকটি ৪৮২ কোটি ৩৪ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। অর্থবছরের দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করেছে এই ব্যাংক। পুরো অর্থবছরের জন্য এই ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বেসরকারি খাতের শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। দুই মাসে ব্যাংকটি ২৫৭ কোটি ২৮ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংকটির কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ২৩১ কোটি টাকা।
কৃষিঋণ বিতরণে এর পরের অবস্থানে রয়েছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। অর্থবছরের দুই মাসে ব্যাংকটি ২৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ২০ দশমিক ৫২ শতাংশ। পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংকটির কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এক হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রায় ১৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংকটির লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ৬৮০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন আরো দেখা যায়, বিতরণ করা কৃষিঋণের অধিকাংশই শস্য খাতে বিতরণ করা হয়েছে। দুই মাসে শস্য খাতে এক হাজার ২৩৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এছাড়া দারিদ্র্যবিমোচনে ১৫১ কোটি টাকা, মৎস্য খাতে ৩৮২ কোটি টাকা, পোলট্রি খাতে ৫৬৫ কোটি টাকা, কৃষি যন্ত্রাংশে প্রায় ১৭ কোটি টাকা, সেচ যন্ত্রাংশ খাতে প্রায় ১৮ কোটি টাকা, খাদ্যভাণ্ডার খাতে ১৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে ৪১০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।
এবার চলতি অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক নীতিমালায় কৃষিঋণ বিতরণের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ বছর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাইরে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক ২০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) ৭২০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে নতুন এ নীতিমালা অনুযায়ী শস্য বা ফল চাষের জন্য সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণের ক্ষেত্রে সিআইবি প্রতিবেদন ও তদন্তের প্রয়োজন হবে না। এছাড়া ব্যাংকঋণের সুদহারের নিম্নমুখী প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে কৃষিঋণের সুদের হার কমানো হয়েছে। ১ জুলাই থেকে কৃষি ও পল্লীঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে এই ঋণের ঊর্ধ্বসীমা ছিল ১০ শতাংশ। ৯ শতাংশ সুদে এ ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহ দিতে সাধারণ সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের হার কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।