নিউজ ডেস্ক:
১৮৪৮ সালের লন্ডন। বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাকেই অনেকে শ্রেয় মনে করতেন। কারণ সেই সময় কলেরায় সম্পূর্ণ এলাকা ছেয়ে গিয়েছিল। আনুমানিক ১৫ হাজার অধিবাসী মারা গিয়েছিল। সমাধিস্থ করার জন্য চার্চের পাশে সারি সারি করে রাখা হতো হাজার হাজার লাশ। কিন্তু সমাধিস্থ করার বিন্দুমাত্র জায়গা অবশিষ্ট ছিল না।
ওই সময়ে লন্ডনের জনসংখা দিন দিন বেড়েই চলছিল। ১৮০১ সালে যেখানে পুরো লন্ডনে বাস করত ১০ লাখেরও কম মানুষ, সেখানে ১৮৫১ সালে তা বেড়ে গিয়ে হয়েছিল ২৫ লাখের কাছাকাছি। কিন্তু সমাধির জন্যে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩০০ একর জায়গা।
প্রতিনিয়ত নতুন কবরের জন্য পুরোনো কবরকে প্রতিস্থাপন করা হতো। এর ফলে পুরোনো লাশগুলো দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল এবং বাতাস আর পানির সংস্পর্শে এসে পরিবেশকে দূষিত করছিল। আর এর কারণেই ভিক্টোরিয়ান লন্ডনে কলেরা, হাম, গুটিবসন্ত, টাইফয়েড প্রভৃতি রোগবালাই মহামারি আকার ধারণ করেছিল।
পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, লন্ডনের কবরস্থানে আর নতুন করে কোনো কবর খোঁড়া যাবে না। নতুন সমাধিস্থল তৈরি করা হবে লন্ডন শহরের বাইরে। লন্ডন শহর থেকে ৩৭ কি.মি. দূরে অবস্থিত ব্রুকউড। সেখানেই তৈরি করা হয় লন্ডনের সবচেয়ে বড় কবরস্থান। ১৫০০ একর জায়গা জুড়ে তৈরি করা হয় এই কবরস্থানটি। যাতে করে পরবর্তী ৩৫০ বছর পর্যন্ত সবাই নতুন কবর পায়। পুরোনো কবর যাতে প্রতিস্থাপিত না হয়।
মৃতদেহ এবং মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের বহন করার জন্য একটি সুনির্ধারিত ট্রেনও চালু করা হয়। যার নাম দেয়া হল ‘লন্ডন নেক্রোপোলিস রেলওয়ে’।
১৮৫৪ সাল থেকে প্রতিদিন একটি ট্রেন কফিন এবং মৃতের আত্মীয়দের নিয়ে ওয়াটারলু স্টেশন থেকে ব্রুকউডের উদ্দেশ্যে রওনা হতো। আর যাত্রাপথে কোথাও কোনো বিরতি না দিয়ে ৩৭ কি.মি. পথ পাড়ি দিতে এই ট্রেনের সময় লাগত ৪০ মিনিট। সবাই দুপুর নাগাদ সমাধিস্থলে পৌঁছে যেতেন এবং সকল কাজ শেষ করে বিকেল ৩টা নাগাদ লন্ডনে ফিরে আসতেন।
রেগুলার ট্রেনের মতো এই ট্রেনেও ক্লাস সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। যারা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কাটতেন তাদের জন্য কবরস্থানের জায়গা পছন্দ করার সুযোগ ছিল। তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী জায়গাতে মৃতের দাফন করতেন। আর যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট কাটতেন তাদের কর্তৃপক্ষ কিছুটা জায়গা সীমাবদ্ধ করে দিতেন সেসব এলাকা বাদে তারা কবর দিতে পারতেন না। ধর্ম এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে ট্রেনের কামরাও ভাগ ছিল।
১৮৫২ সালে কবরস্থান সঙ্কুলানের জন্য লন্ডন শহরের ঠিক পাশেই নতুন করে আরেকটি জায়গায় কবরস্থান বানানোর কাজ শুরু করা হয়। তবে এটা অস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল। মেট্রোপলিটনের ধার ঘেঁষে আরো দুইটি বড় বড় কবরস্থান নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। লন্ডন নেক্রোপোলিস রেলওয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা প্রচার শুরু করেছিলেন যে, তাদের এই ব্যবস্থা নগরায়নের ক্ষেত্রে কোনো বাধা দিবেনা। এবং লাশ বহন করার সময় পথের মধ্যে কোনো জায়গার কোনো ক্ষতি হবেনা। কিন্তু লন্ডন নেক্রোপোলিস রেলওয়ে পরিকল্পনাকারীরা আশানুরূপ ফলাফল পাননি।
১৮৯৪ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত এই ট্রেন মাত্র ২ হাজার ৩০০টি মৃতদেহ বহন করেছিল। যেখানে পরিকল্পনাকারীরা আনুমান করেছিলেন এই সেবা দানকারী ট্রেনটি ৫০ হাজার মৃতদেহ বহন করবে। ১৯০২ সাল থেকে এই ট্রেনটি প্রতিদিন যাতায়াত বন্ধ করে শুধুমাত্র মানুষের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে চলাচল শুরু করে। ১৯৩০ সাল নাগাদ এই ট্রেন একটি অনিয়মিত ট্রেনে পরিণত হয়। সপ্তাহে শুধুমাত্র দুইবার যাতায়াত করতে থাকে।
১৯৪১ সালের ১৬-১৭ এপ্রিলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, আকাশপথে বোমাবাজির ফলে এই লন্ডন নেক্রোপোলিস রেললাইনের অনেক ক্ষতি হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষ পুনরায় এই রেল লাইন মেরামতের বিষয়টিকে অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রায় ৮৭ বছর ধরে ট্রেনটি ২ লাখ মৃতদেহ বহন করেছিল।
তবে খুবই অল্প সংখ্যক স্মৃতি অবশিষ্ট রয়েছে এই ট্রেন সেবাটির। ১৯৬০ সালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে কবরস্থানের দুইটি স্টেশন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ট্রেন লাইনগুলো তুলে অন্যান্য স্থানে ব্যবহার করা হয়েছে। শুধুমাত্র ১২১, ওয়েস্টমিস্টার ব্রিজ রোডের শুরুতে প্রাইভেট রেলওয়ে করপোরেশনের মূল ভবনটি এখনো অক্ষত অবস্থায় আছে। তবে ‘লন্ডন নেক্রোপোলিস রেলওয়ে’ নামফলকটি এখন নেই।
তবে ‘লন্ডন নেক্রোপোলিস রেলওয়ে’ পৃথিবীর একমাত্র লাশবাহী ট্রেন ছিল না। ১৮৬৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সিডনিতে রুকউড কবরস্থানে যাবার জন্যে ‘রুকউড সিডনি লাইন’ নামে একটি ট্রেন ব্যবস্থা চালু ছিল। এছাড়াও মেলবোর্নে ‘স্প্রিং ভ্যালে সিমেন্ট্রি রেলওয়ে’ নামে ট্রেন সার্ভিস চালু ছিল। বার্লিনে ‘ফ্রায়েডহফসবান’ নামে আরেকটি ট্রেন সার্ভিস চালু ছিল। ঠিক একই রকম ট্রেন সার্ভিস চালু ছিল ফিনল্যান্ডেও।