মেহেরপুর প্রতিনিধিঃ মেহেরপুরে ছেলেধরা সন্দেহে প্রেমিক-প্রেমিকাসহ ৪ জন গনধোলাইয়ের শিকার হয়েছে। তবে পুলিশ ও মটর শ্রমিক সদস্যর তৎপরতায় তারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। পরিকল্পনা করে প্রেমিকার পরিবারের পক্ষ থেকে এ ধরণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে প্রেমিককের পরিবার। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২ টার দিকে মেহেরপুর বাসস্ট্যান্ডে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় আহতরা হলো শহরের কাথুলী বাসস্ট্যান্ড পাড়ার রেজাউল ইসলামের ছেলে প্রেমিক রাসেল আহামেদ (২৬), মোনাখালী গ্রামের হাফিজুর রহমানের মেয়ে প্রেমিকা উম্মে হাবিবা মেধা (১৮), শহরের নতুন পাড়ার দুলু ইসলামের ছেলে উৎসুক আমিরুল ইসলাম (২৫) এবং দফরপুর গ্রামের মিজানুর রহমানের ছেলে মাইক্রো চালক দিপু হোসেন (২২)।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মেহেরপুর শহরের কাথুলী বাসস্ট্যান্ড পাড়ার মৃত রেজাউল ইসলামের ছেলে রাসেল আহমেদের সাথে মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালি হাফিজুর রহমানের মেয়ে উম্মে হাবিবা মেধার সাথে বছর দেড়েক আগে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরই মধ্যে তারা একে অপরের সাথে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে। সে অনুযায়ী এর আগে প্রেমিকা মেধা দুই বার প্রেমিকের বাড়িতে চলে আসে। প্রেমিকের পরিবারের লোকজন বুঝিয়ে মেয়েটিকে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেয়। এর পর তারা সিদ্ধান্ত পালিয়ে বিয়ে করবে। সে মোতাবেক পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গতকাল মঙ্গলবার ছেলেটি একটি মাইক্রো ভাড়া করে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালী গ্রাম থেকে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে আসে। এসময় প্রতিবেশী এক মেয়ে চিৎকার করে আশেপাশের লোকজনকে বিষয়টি জানাই। তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে মেহেরপুর কাজি অফিসের দিকে রওনা হয়। বিষয়টি মেধার চাচা মোনাখালি ইউপি চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান জানতে পেরে তাদের আটকানোর নিদের্শ দেন। পরে গ্রামের শত শত লোক মোটর সাইকেল, স্যালো ইঞ্জিন চালিত আলগামনে করে মাইক্রোবাসটি ধাওয়া করে। এসময় মোনাখালী থেকে মেহেরপুর কোর্ট মোড় পর্যন্ত মাইক্রোর পিছু নিয়ে আটকাতে না পেরে ‘ছেলেধরা’ বলে চিৎকার শুরু করে। এসময় মাইক্রোটিও তাদের চিৎকার শুনে স্পিড বাড়িয়ে দেয়। ফলে জনসাধারণের মধ্যে ছেলেধরা আতঙ্কটি প্রবল আকার ধারণ করে। এসময় মাইক্রোটি মেহেরপুর বাসস্ট্যান্ডের মাইক্রো স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়ালে শতশত জনতা মাইক্রো চালক, প্রেমিক ও প্রেমিকাকে ছেলেধরা সন্দেহে গনধোলাই শুরু করে। এসময় অপর আহত আমিরুল ইসলাম তাদের দেখতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে সামনে পড়ে যায়। এসময় তাকেও ছেলেধরা সন্দেহে গনপিটুনি দেয় জনতা।
খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ আব্দুল্লাহ আল মাহামুদের নেতেৃত্বে পুলিশের একাধিক দল সেখানে উপস্থিত হয়ে জনগনের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করে প্রথমে হাসপাতালে এবং পরে থানা হেফাজতে নেয়।
রাসেল আহামেদ জানান, মেধার সাথে গত দেড় বছর ধরে তার প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়। এর আগে সে আরো দুইবার বাড়ি থেকে তার কাছে চলে এসেছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি আরো বলেন, বিয়ে করার জন্য তার কাজি অফিস যাওয়ার জন্য প্রেমিকাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। তাদের মেয়ে ঘরে আঁটকিয়ে না রখতে পেরে ছেলেধরার মিথ্যা প্রচার করে আমাদের মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে।
প্রেমিকা উম্মে হাবিবা মেধা জানান, ঘর বাধার জন্য আমি রাসেলের হাত ধরে ঘর ছেড়েছি। আমাকে বাড়িতে নানা ভাবে নির্যাতন করা হয়। আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না।
অপর আহত আমিরুল ইসলাম জানান, মানুষের ভিড় দেখে সেখানে গেলে একজনের ধাক্কায় আমি নিচে পড়ে যায়। এসময় জনতা আমাকেও ছেলেধরা মনে করে আমার উপর হামলা চালায়।
মেধার চাচা মোনাখালি ইউপি চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান বলেন, লোকমুখে গ্রামে ছেলে ধরা এসেছে শুনে গ্রামের লোকজনকে তাদের ধরতে বলা হয়। তাদের মেয়েকে নিয়ে যাওয়া বিষয়টি তারা পরে জানতে পেরেছেন বলে দবি করেন।
রাসেল আহমেদের বড় ভাই রমজান আলী জানান, এর আগে মেয়েটি তাদের বাড়িতে দুবার চলে এসেছিল। তারা বুঝিয়ে মেয়ের পরিবারের লোকজনের হাতে তুলে দিয়েছে। মেয়েটিকে তারা নানা ভাবে নির্যাতন করে। যে কারণে মেয়েটি তার বাবার বাড়ি থেকে চলে এসেছে।
রাসেলের অন্য ভাই শাহিন ইসলাম জানান, তাদের ভাইকে মেরে ফেলার জন্য ছেলেধরা আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। বারবার মেয়ের পরিবারকে তাগিদ দেওয়া হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। তারপরও বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠভাবে মিমাংসা করতে চাই।
জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক মতিয়ার রহমান জানান, মাইক্রোটি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড় করেছিল না হলে হয়তো রাস্তার মাঝে গনধোলাই সকলেই ছেলেধরা বলে মারা পড়ত। ছেলে ধরা ভেবে করো কথা শুনে ভুল করে কাউকে মারধর না করা হয় সেদিকটা আমাদের কে খেয়াল রাখতে হবে ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ছেলে ধরাসহ মাইক্রোবাস আটক হয়েছে এমন খবর পেয়ে পুলিশ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে জনগনের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করে। মেহেরপুরে বর্তমানে ছেলে ধরা আতঙ্ক চলছে। এসময় ছেলে ধরার সংবাদ সাধারণ জনগনকে উত্তেজিত করে তোলে। তাদের স্থানীয় শ্রমিকদের সহযোগীতায় তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকাসহ চারজনকেই থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত এক মাস ধরে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। পরে তাদের সাথে ছেলেধরার সম্পৃক্ততা না পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।