ইসলাম উদারতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সব মত, পথ ও ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করে বৃহত্তর সমাজ গড়ার উদারনীতি গ্রহণ করেছে ইসলাম। বিগত দেড় হাজার বছর ধরে ইসলাম উদারতা, মানবিকতাবোধ, সম্প্রীতি ও সহিষুষ্ণতার অপূর্ব নজির স্থাপন করে আসছে। এসব নজির দেখা যায় মহানবী (সা.)-এর বিভিন্ন চুক্রিপত্রে।1
যেমন-
মদিনা সনদে সম্প্রীতির নজির
হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তখন মদিনা ছিল পৌত্তলিক, ইহুদি ও মুসলিম—এই তিন সম্প্রদায়ের লোকের একটি আবাসভূমি। রাসুলুল্লাহ (সা.) লক্ষ করলেন, এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপিত না হলে মদিনার শান্তি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাই বিশ্ব শান্তির দূত মুহাম্মদ (সা.) মদিনাবাসীকে একটি লিখিত শান্তির সনদ দান করেন।সনদে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নেতারা স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সনদকে বলা হয় ‘মদিনা সনদ’। মদিনা সনদই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বা সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে।
যেমন—‘সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় মদিনা রাষ্ট্রে সমান অধিকার ভোগ করবে, সব ধর্ম সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারো ওপর আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ওই আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোনো নাগরিক কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। ’ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ)
হুদায়বিয়ার সন্ধিতে সম্প্রীতির নজির
মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির কয়েকটি ধারা ছিল মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হজরত মুহাম্মদ (সা.) তা মেনে নেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর সন্ধিতে মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের সঙ্গে ‘রাসুলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে আপনি আল্লাহর রাসুল, তাহলে তো আর আপনার সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লিখো।এতে আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করায় রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন।
মদিনায় দুই গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনরাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের প্রাক্কালে মদিনার দুটি পরাক্রমশালী গোত্র (আউস ও খাজরাজ) দীর্ঘদিন ধরে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। এক পর্যায়ে এই দ্বন্দ্ব ভয়াবহ যুদ্ধের আকার ধারণ করলে মহানবী (সা.) অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ওই গোত্রদ্বয়ের বিরোধ মীমাংসা করেন এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সিসা ঢালা প্রাচীরের মতো ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির সেতু স্থাপন করে দেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরে শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানিতে তোমরা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেছ। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
মক্কা বিজয়ের দিন সাধারণ ক্ষমা
ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী (সা.) বিজিত শত্রুদের প্রতি কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করেননি এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ প্রতিশোধস্পৃহাও প্রকাশ করেননি, বরং দুশমনদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশরা! আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব বলে তোমরা মনে করো?’ তারা বলল, আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। ’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি তোমাদের সঙ্গে সে কথাই বলছি, যে কথা ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন—‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৯২)