নিউজ ডেস্ক:
ঠোঁটের কোনে সার্বক্ষণিক লেগে থাকা ফোকলা দাঁতের নির্মল হাসিটায় বুদ হয়েছিল বিশ্ব। কত শত শুভেচ্ছা বার্তা আর প্রার্থনা। সাথে মনের ভেতর নির্মম এক সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রহর গোনা। তার এক হাসিতে মুহুর্তেই ম্লান হয়ে গিয়েছিল নিউক্যাসেল-সান্ডারল্যান্ড থেকে শুরু করে ফুটবল মাঠের কত শত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিরোধ, বৈপরীত্য আর বিদ্বেষ। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে মিশে গিয়েছিল লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি থেকে শুরু করে এভারটন, আর্সেনালসহ অন্য সবাই। লক্ষ্য একটাই, এই স্বর্গীয় হাসিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ছিল যে ভিন্ন।
মনে করে দেখুন তো, ছয় বছর বয়সে আপনার জীবনটা কেমন ছিল? বাবা-মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে হৈ চৈ, দিনভর খেলাধুলা করে বেড়ানো এমন সব মধুর স্মৃতিই হয়তো আপনাকে স্মৃতিকাতর করে তুলবে। সব মিলিয়ে এমন এক সময় যেখানে নেই কোন ভাবনা-চিন্তা, জীবন সংগ্রাম, জীবিকা উপার্জনের তাগিদ।
তবে ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকহল কলিয়েরিতে ২০১১ সালে জন্মগ্রহন করা ব্র্যাডলি লরি’র গল্পটা একদমই ভিন্ন। বয়স যখন মাত্র ১৮ মাস, তখন ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে তার শরীরে দানা বেঁধেছে নিউরোব্লাস্টমা নামক খুবই বিরল এক ধরনের ক্যান্সার। বলা হয়েছিল আর বড়জোর কয়েক মাস বাঁচবে সে। সেই থেকে শুরু ছোট্ট শিশু ব্র্যাডলি’র দানবীয় ক্যান্সারের সাথে লড়ে যাওয়ার গল্প। এই অসম লড়াইয়ে একবার ক্যান্সারকে পরাজিত করে বিজয়ীর বেশে ২০১৪ সালে ঘরেও ফিরেছিল সে। কিন্তু ২০১৬ সালের জুলাইতে জানা যায় আবারো ব্র্যাডলির শরীরে ফিরে এসেছে মরনঘাতী ক্যান্সার। আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর একই বছরের ক্রিসমাসে সবাই যখন উদযাপনে ব্যস্ত সে মুহুর্তে ব্র্যাডলির বাবা মাকে জানানো হয় শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে ব্র্যাডলির ক্যান্সার। যেখান থেকে কার্যত নিরাময়ের আর কোন উপায় নেই, নেই ইংল্যান্ডে তার ভালো কোন চিকিৎসাও। বাবা মায়ের মন বলে কথা। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে ছেলেকে চিকিৎসা করাতে অর্থ তহবিল সংগ্রহে নেমে গেলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তা নিয়ে।
ইংলিশ ক্লাব সান্ডারল্যান্ডের পাড় ভক্ত ব্র্যাডলিকে তার প্রিয় ক্লাব আমন্ত্রণ জানায় তাদের ম্যাচে মাসকট হিসেবে মাঠে প্রবেশের জন্য। এর পর আরো বেশি ফুটবল বিশ্বের নজরে চলে আসে ব্র্যাডলি। ক্যান্সারের সাথে তার অসম কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী এই লড়াই এর খবর নাড়া দেয় ফুটবল বিশ্বকে। আস্তে আস্তে তার চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় প্রায় পুরো অর্থই উঠে আসে সবার সম্মিলিত চেষ্টায়। কিন্তু ততদিনে ক্যান্সার যে চলে গেছে এমন এক পর্যায়ে যেখানে টাকা একেবারেই মূল্যহীন।
জীবন যে ফুটবলের চেয়ে অনেক বড়- ব্র্যাডলি লরির কল্যাণে এই সত্য আরো একবার উপলব্ধি করল ফুটবল বিশ্ব। ফুটবল মাঠের সব প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে পেছনে ফেলে #OneBradley স্লোগান নিয়ে এক কাতারে সম্মিলিত হলেন সবাই। স্রষ্টার সান্নিধ্যে যাবার আগের শেষকয়টা দিন যেন সর্বোচ্চ আনন্দে কাটাতে পারে ছোট্ট শিশুটি সে চেষ্টার কমতি রইলনা কিছুতেই।
এই সময়ের মধ্যে সান্ডারল্যান্ডের বেশির ভাগ ম্যাচেই মাসকট হিসেবে মাঠে দেখা গেছে ব্র্যাডলি লরিকে। গত ডিসেম্বরে চেলসির সাথে ম্যাচের আগে ব্র্যাডলির স্পট কিক, গোলরক্ষক বেগোভিচের ইচ্ছে করে হেলে পড়ে হজম করা সে গোল আর তারপর ব্র্যাডলির উচ্ছ্বাস অবতারণা করেছিল এক স্বর্গীয় দৃশ্যের।
এই ছোট্ট জীবনে ক্যান্সারের লড়াইয়ে সে পাশে পেয়েছিল ফুটবলের অনেক রথী মহারথীদের। সবার মত এই ছোট্ট শিশুর সংক্রামক হাসি কাছে টেনেছিল তার প্রিয় তারকা সে সময়ে সান্ডারল্যান্ডে খেলা জার্মেইন ডিফোকেও। মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নিতেন সে টান থেকে। মাসকট হিসেবে মাঠে আসা সেই ব্র্যাডলি ধীরে ধীরে হয়ে গেল জার্মেইনের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’। এরপর থেকে তাকে কোলে নিয়ে জার্মেইনের মাঠে আসা হয়ে উঠল ফুটবল বিশ্বের খুব পরিচিত একটি দৃশ্য। নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। হাসপাতালে দেখতে যেতেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তার কোলে মাথা রেখে তার ‘ছোট্ট বন্ধু’র শান্তির ঘুমের ছবি নাড়া দিয়েছিল বিশ্বকে। ব্র্যাডলিকে কোলে নিয়ে মাঠে যাওয়া, তার সাথে ম্যাচের আগে ওয়ার্ম আপ করা, তার জন্মদিনে যোগ দেওয়া সর্বত্রভাবেই বন্ধুর জীবনের শেষ দিনগুলো রাঙ্গিয়ে তুলতে জার্মেইনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ফুটবলকে তুলে ধরেছে আরো উচ্চে, ঘোষণা করেছে মানবতার জয়গান।
বেগোভিচকে করা সেই গোলের জন্য বিবিসি গোল অফ দ্যা মান্থ, ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে লক্ষাধিক দর্শকের সামনে মাসকট হিসেবে মাঠে প্রবেশ, চাইল্ড অফ কারেজ অভিধা, জন্মদিনে অন্তত আড়াই লাখ শুভেচ্ছা কার্ড ব্র্যাডলির দিনগুলোকে করে তুলেছিল অনেকটাই রঙ্গিন।
তবে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি তাকে। গত ৭ জুলাই সবাইকে ছেড়ে বাবা মায়ের কোলেই পরপারে পাড়ি জমায় ব্র্যাডলি লরি। সে কথা ভগ্নচিত্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা করেন তার মা।
মাসকট হয়ে আর মাঠে আসবে না ছোট্ট ব্র্যাডলি, আর দেখা যাবে না জার্মেইন ডিফোর কোলে, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে না তার বন্ধুর জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবরে। চেলসির বিপক্ষে সেই গোলই তার জীবনের শেষ গোল হয়ে থাকবে, গ্লাভস হাতে তাকে থাম্বস আপ দিতে দেখা যাবে না আর কখনোই, আর কখনোই বিশ্ব দেখবে না তার ভুবন ভোলানো ফোকলা দাঁতের হাসি।
কিন্তু বিশ্ব কি ভুলে যাবে তাকে? ভুলে যাবে হেসেখেলে বেড়ানোর বয়সে মরনঘাতী ক্যান্সারের সাথে তার দুঃসাহসী লড়াইয়ের কথা? ভুলে যাবে এক ব্র্যাডলির হাত ধরে সাপে নেউলে সম্পর্কের দুই ক্লাবের এক হয়ে যাওয়ার গল্প? কখনোই না। বরং এক ব্র্যাডলি লরি বেঁচে থাকবে সাহসিকতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে। জীবন যুদ্ধে হেরেও জিতে যাওয়া ব্র্যাডলি লরি যুগের পর যুগ সাহস যুগিয়ে যাবে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করতে।
ভালো থেকো ব্র্যাডলি লরি।