রাজধানী কিংবা এর আশপাশ ছাড়িয়ে বিকাশ প্রতারণার কেন্দ্রস্থল এখন ফরিদপুরের মধুখালীতে। সেখানে বসে প্রতারণার কাজ করছে একটি চক্র। কল সেন্টারের নম্বর ক্লোন, অঙ্কের ধাঁধায় ফেলে গ্রাহকের পিন নম্বর হাতিয়ে নেয়ার কাজ। এরপর শুরু হয় প্রতারণা।
এই চক্রের মূলহোতা সালমান ও টিটু। তাদের সহযোগিতা করে আকাশ ও নয়ন। এছাড়া মোহাজ্জেল ও লিটন ঢাকা থেকে টাকা তুলে পাঠিয়ে দেয় ফরিদপুরে। দোকান থেকে রেজিস্ট্রার খাতার পাতার ছবি তুলে দেয় রানা।
ডিবি পুলিশ সূত্র বলছে, এ কাজে ব্যবহার করা হয় আইফোন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতারণা কর্মকাণ্ডের পুরোটাই তদারকি করা হয় ফরিদপুরের মধুখালী থেকে। বিকাশ কল সেন্টারের নম্বর ক্লোন করা ছাড়াও ধাঁধায় ফেলে গ্রাহকের গোপন পিন নম্বরও বের করে নিচ্ছে এই প্রতারক চক্র।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর মধুখালী থেকে চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। তারা হলো, মো রানা খান, মো. লিটন, মো. নয়ন শেখ, মো. টিটু মোল্লা, মো. সালমান মোল্লা, আকাশ শেখ, মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, মো. রহিম ও মো. তানজিল। এ সময় তাদের থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ২টি আইফোনসহ ১০টি মোবাইল, ৩৭টি সিম ও ১টি প্রোবক্স গাড়ি উদ্ধার করা হয়।
যেভাবে গ্রাহকদের বোকা বানানো হয়:
শুরুতেই বিকাশ দোকানদার সেজে গ্রাহকের কাছে ফোন করে জানতে চাওয়া অতিরিক্ত কোনো অর্থ তার বিকাশ অ্যাকাউন্টে গিয়েছে কি না। এ সময় না বুঝে অনেকেই টাকাও দিয়ে দেন। আর যারা বিষয়টি বুঝে ফেলেন তাদেরকে বলা হয় বিকাশ অফিস থেকে তাকে ফোন করা হবে। সঙ্গে এসএমসে জানানো হয় তার অ্যাকাউন্টটি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির হাতে গ্রেফতারের পর তাদের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে এভাবেই বর্ণনা করেন প্রতারকরা।
যেভাবে ক্লোন হয় বিকাশের কল সেন্টারের নম্বর:
বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে বিকাশের কল সেন্টার থেকে দেয়া হয় ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে বিকাশ কল সেন্টারের নম্বর। কিন্তু এখানেও শুভঙ্করের ফাঁকি। যা একটি বড় কৌশল। বিকাশের কল সেন্টারের নম্বর ১৬২৪৭। তবে, ফোনটি যে নম্বর থেকে আসে তার সামনে থাকে প্লাস ও একটি শূন্য। আসল ও নকল বিকাশ কল সেন্টারের নম্বরের সামান্য এই পার্থক্য ধরতে পারেন না অনেকেই। তাই সহজেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, আসামিরা তাদের সোর্সের কাছ থেকে বিকাশ এজেন্টের ক্যাশ-ইন রেজিস্ট্রার খাতার পাতা ২০০-৩০০ টাকায় কিনে যাদের মোবাইলে টাকা গেছে তাদের ফোন দিয়ে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে টাকা হাতিয়ে নিতো।
বিকাশের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, প্রথম ফোনের কিছুক্ষণ পর মূল হ্যাকার বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে বিকাশ অফিসের নাম করে বিকাশ সেন্টারের মূল নম্বরের সদৃশ্য নম্বর থেকে ভিকটিমকে কল দিতেন। ভিকটিমের নম্বরে তখন +০১৬২৪৭ থেকে কল আসে। কল সেন্টারের ওই ব্যক্তি ভিকটিমের নম্বরে একটি ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) পাঠাতেন এবং কৌশলে পাঠানো ওটিপি ভিকটিমের কাছে জানতে চায়। ভিকটিম প্রতারিত হয়ে তার কাছে পাঠানো ওটিপি এবং পিন নম্বর বলে দেয়।
প্রতারণার কাজে আইফোন ব্যবহার প্রসঙ্গে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, +০১৬২৪ একটি ডায়ালার সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রতারক। এটি দিয়ে তারা এক হাজার টাকায় ১০০ মিনিট কিনে কলগুলো জেনারেট করে যাকে বলা হয় স্কুপিং।
তিনি বলেন, এতে করে যাকে কল দেবেন তার যে নির্দিষ্ট নম্বর দরকার সেটি অটোমেটিক দেখা যাবে। যদি বিকাশ অ্যাপ অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে থাকে তবে ওটিপি দিয়ে নির্দিষ্ট নম্বর পেয়ে যায় তারা। এটাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণা করে আসছে।
বিকাশ প্রতারণা থেকে সাধারণ গ্রাহককে সচেতন হতে ডিবির উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জানান, বিকাশের নামে নানা সমস্যার কথা বিকাশ থেকে কখনই বলবে না। যদি কেউ বলে তাহলেই ধরে নিতে হবে এরা প্রতারক, আপনি প্রতারণার শিকার হতে যাচ্ছেন।
বিকাশ কোম্পানির উদাসীন মনোভাব প্রসঙ্গে তিনি জানান, কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে গেলে তারা বলেন, পুলিশের কাছে যেতে। তারা যদি আমাদের উপরে ছেড়ে দেয়, তাহলে তাদের নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কোথায়?
যেখানে সেখানে বিকাশের দোকান সম্পর্কে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, এখন ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বিকাশের দোকান। যাদের দোকানে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। এগুলো নিশ্চিত করে বিকাশ এজেন্ট দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।