নিউজ ডেস্ক:
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল সোমবার ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটের খসড়া চূড়ান্ত করেছেন।
এদিন সকাল থেকে সচিবালয়ে তার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে বসে প্রতিবারের মতো কম্পিউটারে নিজ হাতে বাজেটের খসড়া চূড়ান্ত করেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় অর্থসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এবং অতিরিক্ত সচিব ফজলুল বারি তাকে সহায়তা করেন। এর আগে এফবিসিসিআই নেতারা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন।
অর্থমন্ত্রী আগামী ১ জুন দুপুর দেড়টায় জাতীয় সংসদে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে টানা নবমবারের মত বাজেট উপস্থাপন করবেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি হবে তার ১১তম বাজেট। এর আগে এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দুটি বাজেট দিয়েছিলেন তিনি। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বাজেট বক্তৃতা সোমবার সন্ধ্যায় বিজি প্রেসে পাঠানোর কথা। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমার বাজেট বক্তৃতা চূড়ান্ত করেছি। মোটামুটি সব ঠিক আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। আশা করি আগামী ১ জুন সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবো।
এবারের বাজেট চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটের একটি বড় অংশই চলে যাবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভর্তুকি ও ঋণের সুদ পরিশোধে। ৪ লাখ কোটি টাকার বিশাল বাজেটের ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে এ তিন খাতে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ তিন খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এ তিন খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ১৬ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, আসন্ন বাজেট হবে দেশের সর্ববৃহৎ বাজেট। বিশাল ব্যয়ের এ বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয় খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির ১১ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা পরিশোধে। এ খাতে ব্যয় হবে জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হবে দেশি ও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ। এ খাতে ব্যয় হবে জিডিপির ১ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে ব্যয় হবে জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ। এ তিন খাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রায় ৩১ শতাংশ ব্যয় হবে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারি সাড়ে ১২ লাখ চাকরিজীবীর বেতন-ভাতা পরিশোধে ৫২ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে যা ৪৯ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা রয়েছে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ২ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের পয়লা বৈশাখ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে আসন্ন বাজেটে এ ব্যয় বাড়ছে। এ ছাড়া বাজেটে ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের প্রতিস্থাপনের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা আসতে পারে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট শুধু আকারের দিক থেকে নয়, ঘাটতির পরিমাণও বাড়তে পারে। বাজেটে ঘাটতি ধরা হতে পারে ১ লাখ ২৯ হাজার ১০ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বাজেটে যা ছিল ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া হতে পারে ৫৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া হতে পারে ৪৮ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ২৫ হাজার ৮২০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হতে পারে। বছর শেষে এসব ঋণের সুদ বাবদ খরচ হবে ৪২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৩ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এ হিসেবে ভর্তুকি প্রণোদনা ও নগদ ঋণ বাড়ছে ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। আসন্ন বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত অন্যান্য খাতে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হচ্ছে। আর প্রণোদনা বাবদ বাজেটে কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) অনুকূলে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। রপ্তানিতে ৪ হাজার কোটি টাকা ও পাটজাত দ্রব্যে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য কোনো ভর্তুকি রাখা হচ্ছে না। বিশ্ববাজারের তুলনায় অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলে লাভ থাকায় এ খাতে কোনো ভর্তুকি রাখছে না সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে যারা বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন তারা জনপ্রতি মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা পরিবর্তে ৬০০ টাকা করে পাবেন। একইসঙ্গে উপকারভোগীর সংখ্যা বর্তমান ৩১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৩৫ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে।
বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের ভাতা ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকে তারা এই হারে ভাতা পাবেন। আর উপকারভোগীর সংখ্যা ১১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১০ ভাগ বাড়িয়ে ১২ লাখ ৬৫ হাজার করা হচ্ছে।
আগামী অর্থবছর থেকে অসচ্ছ্বল প্রতিবন্ধীরা ৬০০ টাকা পরিবর্তে ৭০০ টাকা করে মাসিক ভাতা পাবেন। উপকারভোগীর সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখ থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে আট লাখ ২৫ হাজার।
আগামী অর্থবছর থেকে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমের অধীনে বিভিন্ন স্তরের প্রদেয় বিশেষ ভাতা/বয়স্ক ভাতা ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। উপকারভোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৯৭০জন থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭ হাজার ৫৫০জন।
বর্তমানে বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমে অধীনে উপকারভোগীরা মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পান। আগামী অর্থবছর থেকে তারা ৭০০ টাকা করে ভাতা পাবেন। এ জন্য সরকারকে এ খাতের বরাদ্দ ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ কোটি ৬৮ লাখ উন্নীত করা হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
আগামী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তির হার প্রাথমিক স্তরে ৪০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৭০০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১২০০ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে উপকারভোগীর সংখ্যা শুধুমাত্র প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ৫ হাজার করে ১০ হাজার বৃদ্ধি করে ৭০ হাজার স্থলে ৮০ হাজার করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের আর্থিক সহ্য়াতা কর্মসূচির অধীনে বরাদ্দ ৩০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এবং প্রতিজন সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা সহায়তা পাবেন।
চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ খাতে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে খাদ্য সহায়তার পরিবর্তে উপকারভোগীদের জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা ভাতা না বাড়লেও দুটি উৎসব ভাতা পাবেন। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধারা মাসে ১০ হাজার করে সম্মানি ভাতা পাচ্ছেন। আগামী অর্থবছরে এই হার অপরিবতিত থাকছে। কিন্তু তারা এখন থেকে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা দুটি উৎসব ভাতা পাবেন। যা চলতি ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর থেকে তারা এ ভাতা পাবেন।