‘কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি’ এবং উভয় দেশের ‘রাজনৈতিক উত্তেজনার’ মধ্যেই সোমবার ঢাকায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি নিজ নিজ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে এটিই উচ্চ পর্যায়ের প্রথম বৈঠক।
এবং এ বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন বাংলাদেশে সনাতন ধর্মীয় একজন নেতার গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারত, সাথে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের অভিযোগও তুলেছে – আবার কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে হামলার ঘটনা নিয়ে প্রতিবেশী দুইদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠক থেকে বড় কিছু অর্জনের সুযোগ না থাকলেও, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই দেশ বৈঠক বা আলোচনায় বসেছে- এটাই হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
“সীমান্ত, বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, পানির মতো অনেক বিষয় দুই দেশের আলোচনায় সাধারণ ভাবে থাকে। তবে, এজেন্ডায় শেষ পর্যন্ত কী থাকবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট উইং কাজ করছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন এজেন্ডায় যাই থাকুক, সব ধরনের উস্কানি নিরসন করে উত্তেজনা কমিয়ে এনে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এবারের এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটি ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) নামে পরিচিত। এটি মূলত দুই দেশের সব বিষয় নিয়েই আলোচনার একটি ফোরাম।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল তার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেছেন, এফওসি বৈঠক হলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি কাঠামোবদ্ধ বিষয় এবং ভারতও এ বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে।
ব্রিংফিংয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একজন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মি. জয়সোয়াল বলেছেন ‘আইনি অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচারের বিষয়টি ভারত আবারও উল্লেখ করছে’।
ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বৈঠক একটি নিয়মিত ও স্বাভাবিক কূটনৈতিক কার্যক্রম হলেও বিভিন্ন কারণে এবারের বৈঠকটি অতিরিক্ত আগ্রহ তৈরি করেছে।
বৈঠকটির বিষয়ে গত বুধবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, “এটা খুবই স্পষ্ট, আমরা চাই ভালো সম্পর্ক। তবে সেটা ‘রেসিপ্রোকাল’ হতে হবে, দুই পক্ষকেই চাইতে হবে এবং সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।”
মূলতঃ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘সংখ্যালঘু ইস্যুতে’ দুই দেশের সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি হয়েছে।
এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর ঘটনাপ্রবাহ দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে – তাতে এই বৈঠকে কী আলোচনা হয়, এবং এখান থেকে নতুন কোন দিকে পরিস্থিতি মোড় নেয় কী-না তা নিয়ে আগ্রহ আছে মানুষের মনে।
সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বিবৃতি ছাড়াও বাংলাদেশে সনাতম ধর্মাবলম্বীদের একজন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ করে’ গ্রেফতারের ঘটনার জের ধরে ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে হামলার ঘটনায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
ইতিমধ্যে ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন।
এদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর মি. ভার্মা সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, কোনো নির্দিষ্ট একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যাবে না।
“আমরা আমাদের আলোচনা চলমান রাখবো। বৈঠক তারই একটা অংশ। আমাদের বিস্তৃত সম্পর্ক রয়েছে, পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে,” বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও ভারতের নাম উল্লেখ করে নানা মন্তব্য করেছেন, যা ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভারত বিরোধী প্রচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আবার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ব্যাপকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে- ভারতীয় মিডিয়ায় এমন প্রচারেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ সরকারও এ ধরণের খবর সত্য নয় বলে দাবি করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক করেছেন।
আবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এবারের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নেতাদের পক্ষ থেকে ভারতকে নিয়ে যেসব বক্তব্য বিবৃতি এসেছে, তাতে ভারতের দিক থেকেও নিরাপত্তা ইস্যুতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন, সব মিলিয়েই দুই দেশের মধ্যে ‘সম্পর্কের শীতলতা’ কিংবা ‘উত্তেজনা’ তৈরি হয়েছে।
“এখন বৈঠকে যদি এই উত্তেজনা কমিয়ে আনতে দুই দেশ একমত হতে পারে, তাহলেও তো সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। সেটিই হওয়া উচিত,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে, ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যে ধারণা দিয়েছেন তাতে ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়টি আলোচনায় আসবে কী-না তা এখনো নিশ্চিত নয়।
যদিও ভারতে অবস্থান করে শেখ হাসিনার বক্তব্য বিবৃতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং বিভিন্ন সাক্ষাতকারে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
গত সপ্তাহে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছেন। লন্ডনেও একটি অনুষ্ঠানে তার টেলিফোনে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতে অবস্থান করে শেখ হাসিনার বিবৃতি দেয়ার বিষয়টিতে বাংলাদেশের সরকারের আপত্তির বিষয়টি আলোচনায় আসতে পরে বলে অনেকে মনে করছেন।
একই সাথে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম ও কিছু রাজনৈতিক দলের সংখ্যালঘু ইস্যুতে ‘অপতথ্য প্রচার’ এর বিষয়টিতেও ভারতীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়টি আলোচনায় থাকবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
তবে, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বা এমন কিছু এই আলোচনায় আসার সুযোগ নেই।
কারণ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আগেই বলেছে বিচারিক আদালতে শেখ হাসিনা বিরুদ্ধে করা মামলার যে বিচার চলছে, তার রায় হবার পরেই তারা এ বিষয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করবে।
আলোচনায় কী কী আসতে পারে ?
পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এ বৈঠকে আলোচনার জন্য প্রাথমিক এজেন্ডা ঠিক করে থাকে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো।
আবার আলোচনার সময় অনেক ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিষয়ও উঠে আসে। তবে ঠিক কী নিয়ে আলোচনা হবে তা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত এজেন্ডা ঘোষণা বা প্রকাশ করেনি কোন পক্ষই।
কর্মকর্তারা যে ধারণা দিচ্ছেন তা হলো, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের যে কোন আলোচনায় কয়েকটি বিষয়টি নিয়মিত আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ যেমন অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন কিংবা আরও বিশেষ ভাবে তিস্তাসহ কিছু নদীর পানির বিষয়টি উল্লেখ করে থাকে।
এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা ও সীমান্ত পরিস্থিতিও গুরুত্ব পেয়ে থাকে।
পাশাপাশি গত পাঁচই অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে ভিসা কার্যক্রম অনেকটাই বন্ধ করে রেখেছে ভারত। বৈঠকে এ বিষয়টিও উঠে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে এর বাইরেও যে বিষয়টির দিকে সবার নজর থাকবে সেটি হলো- সংখ্যালঘু ইস্যুকে ঘিরে দুই দেশ তাদের নিজেদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে কী-না কিংবা কিভাবে করে।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ভারত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলে আসছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ সত্যি নয় বলে মনে করে এবং তারা মনে করে ভারতীয় গণমাধ্যম ও কিছু রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে অপপ্রচার ও অতিরঞ্জন করছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, ভারতের সরকারি দলের লোকজনকেই বাংলাদেশ নিয়ে বেশি কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।
এখন দুই দেশ যদি একমত হয় যে উত্তেজনা কমিয়ে আনা হবে – তাহলেই সম্পর্কের শীতলতা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে।
প্রসঙ্গত, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি কাল সোমবারই ঢাকায় এসে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেবেন।
সফরকালে তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথেও সাক্ষাত করবেন। তবে প্রধান উপদেষ্টার সাথে তার সাক্ষাত চূড়ান্ত হয়েছে কী-না সেটি এখনো জানা যায়নি।