নিউজ ডেস্ক: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের ধস হতে পারে—এমন আশঙ্কাতে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের দরপতন হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাজারকে ঠিকভাবে সাপোর্ট দিতে পারছে না তারল্যের অভাবে। গেল সপ্তাহে ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমানোর ফলে পুঁজিবাজারে তারল্য কমতে শুরু করে। ফলে দরপতন ঠেকানোর মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতাও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নেই। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা এডিআর কমানোর আশঙ্কায় এতটা দরপতনকে অতিরিক্ত প্রভাবিত (ওভার রিঅ্যাক্ট) হওয়া বলে আখ্যা দিচ্ছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যে দেখা গেছে, গতকাল রবিবার ডিএসই’র সার্বিক মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১৩৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৮৮৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এর আগে ২০১৩ সালের ৯ জুন ডিএসইএক্স কমেছিল ১৪৫ পয়েন্ট। অর্থাত্ গত প্রায় সাড়ে চার বছরের মধ্যে গতকাল সর্বোচ্চ দরপতন হলো। এদিকে পুঁজিবাজারে এতোটা দরপতন হলেও দাপট কমেনি লোকসানি কোম্পানিগুলোর। গতকাল বাজারে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে দীর্ঘদিনের লোকসানি কোম্পানি দুলামিয়া কটনের। কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এছাড়া ‘জেড’ ক্যাটাগরির আরও কয়েকটি কোম্পানি ছিল দর বৃদ্ধির তালিকায়। গতকাল বাজারে ৩৩৬টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে, এর মধ্যে ৩০২টি অর্থাত্ ৯০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে।
দরপতনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, একদিনে এত বেশি সূচক কমে যাওয়ার তেমন কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর (ঋণ আমানত অনুপাত) কমানোর কারণে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার বাড়বে। ফলে পুঁজিবাজার থেকে কিছু টাকা ব্যাংকে চলে যাওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহে কিছুটা সংকোচনের ইঙ্গিত দিয়েছে। এর প্রভাব রয়েছে বাজারে। আর খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, বাজারে এরও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তবে ২০১৪ সালে রাজনীতিতে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলেও বাজারে এত দরপতন হয়নি। তাই এসব কারণে এত বেশি দরপতন হওয়ার কথা নয়।
এদিকে চারদিনে ২৮৮ পয়েন্ট পড়ে যাওয়াকে বাজার ধস বলা যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আবু আহমেদ বলেন, ধস হওয়ার আগে বাবল হতে হয়, বাজারে এমন কোনো বাবল হয়নি। তাছাড়া টানা চার/পাঁচদিন ব্যাপক দরপতন হলে তাকে ধস বলা যেতে পারে। সে হিসেবে এখনই একে বাজার ধস বলা ঠিক হবে না। কারণ গত চারদিনের প্রতিদিনই বড় ধরনের দরপতন হয়নি।
আইডিএলসির দৈনন্দিন বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গতকাল বাজারে দরপতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই)। এনবিএফআই খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম গড়ে ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ কমেছে। আর ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমেছে গড়ে ৩ দশমিক ২০ শতাংশ।
বাজারে ব্যাপক দরপতনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে এমটিবি ক্যাপিটালের সিইও এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খায়রুল বাশার বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মুদ্রানীতিকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক (প্যানিক) তৈরি হয়েছে। এতে সূচক কমে যাচ্ছে। তাছাড়া ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর অনেকেই এক্সপোজারের (শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের নির্দিষ্ট সীমা) কারণে বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার ছেড়ে দিলেও তারা বাজারকে সাপোর্ট দিতে পারছে না।
বাজার পতনের কারণ সম্পর্কে ব্র্যাক ইপিএলের হেড অব পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট সৈয়দ আদনান হুদা বলেন, বাজারে কিছুটা তারল্য সংকট রয়েছে। এডিআর কমানোর ফলে তারল্য কমতে শুরু করেছে। তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কাও রয়েছে। তবে এসবের জন্য এত বেশি দরপতন কাম্য নয়। বাজার অতিরিক্ত প্রভাবিত (ওভার রিঅ্যাক্ট) হচ্ছে।
জরুরি বৈঠক:এদিকে পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক দরপতনের পেছনে আরও পতনের গুজব এবং বিনিয়োগ বাড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতার অভাবকে দায়ী করছে ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। গতকাল বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন (বিএমবিএ) এবং ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে শীর্ষ ৩০ ব্রোকারকে নিয়ে জরুরি বৈঠক শেষে ডিবিএ সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, বাজার খারাপ হলে প্রাতিষ্ঠানিক বড় বিনিয়োগকারীদের থেকে যে সাপোর্ট পাওয়া যেত এবার সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অতীতে বহু রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে অনেক গুজবের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারের ঘটনা একটু বেশি আতঙ্ক (প্যানিক) সৃষ্টি করেছে।
এসময় বিএমবিএ সভাপতি মুহাম্মদ নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে যেসব সমস্যা হচ্ছে; সেগুলো সমাধান করতে হবে। বিশেষ করে এক্সপোজারের সমস্যা। কারণ আমরা বাজারকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল করতে চাই। সাময়িক সাপোর্ট দিয়ে বাজারকে ইতিবাচক করা সঠিক সমাধান নয়।