নিউজ ডেস্ক:
পাটের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনতে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল ভিসকস রেয়ন (এক ধরনের সেমি-সিনথেটিক ফাইবার) ও কাগজের কাঁচামাল পাল্প তৈরিতে পাটের ব্যবহার হবে পাটশিল্প বিকাশে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র। পাটের এমন বহুবিধ ব্যবহার একদিন পাটকে আবারো প্রধান রপ্তানিপণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অডিটোরিয়ামে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং ইউএসএআইডি যৌথভাবে আয়োজিত ‘পাট হতে পরিবেশবান্ধব পাল্প ও কাগজ প্রস্তুত’ বিষয়ক সেমিনারে বক্তরা এসব কথা বলেন।
সেমিনারের প্রধান অতিথি পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পাটের গুরুত্ব বোঝাতে ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস ঘোষণা ও প্রথমবারের মতো দিবসটি উদযাপন করা হয়। কাঁচাপাট রপ্তানিকে নিরুৎসাহিত করতে ম্যানডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্টের আওতায় পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে দেশের পাটের ব্যবহার ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব উদ্যোগে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক পাটের ন্যায্য পাচ্ছে।
পাট ব্যবহারের নতুন সম্ভাবনা ভিসকস রেয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, পাট দিয়ে গার্মেন্টস খাতের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারযোগ্য ভিসকস রেয়ন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নরসিংদীতে প্ল্যান্ট তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। যেখানে ৩০ হাজার টন ভিসকস রেয়ন তৈরি হবে। আর এতে ৫০ হাজার টন পাট দরকার হবে। বর্তমানে বস্ত্রখাতের কাঁচামাল হিসেবে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার ভিসকস আমদানি করতে হয়।
কাগজ তৈরিতে পাট দিয়ে পাল্প উৎপাদনের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, কাগজ তৈরিতে পাট দিয়ে পাল্প উৎপাদন নতুন ভাবনা। এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে কাঁচাপাট আর রপ্তানি করতে হবে না। পাটে এমন বিভিন্ন ব্যবহারে এর সুদিন ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্ব পলিথিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিশ্বে প্যাকেটিংয়ে ৫০০ বিলিয়ন পলিথিনের প্যাকেট লাগে। সেক্ষেত্রে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে শুধুমাত্র প্যাকেজিংয়ে পাটের বিশাল বাজার রয়েছে।
মির্জা আজম বলেন, একসময় পাট ছিল বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী পণ্য্। যা দিয়ে বাংলাদেশকে চিনত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান পাটশিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের পাটকলগুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে পাটের দুর্দিন নেমে আসে। ৭৫ পরবর্তী সময়ের সরকারগুলো বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেশের পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০০২ সালের তৎকালীন বিএনপি সরকার গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের মাধ্যমে ৪০ হাজার শ্রমিককে বিদায় করে আদমজি বন্ধ করে বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছিল।
পাট প্রতিমন্ত্রী বলেন,দেশে বর্তমানে ৮৫ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হচ্ছে। এটাকে ১ কোটি বেলে উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সারা দেশে বিজেএমসির আওতাধীন পাটকলসমূহের অব্যবহৃত জায়গায় বস্ত্র ও পাটবিষয়ক শিল্প-কারখানা স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোক্তাবৃন্দ আগ্রহ প্রকাশ করলে সরকার জায়গা বরাদ্দের পাশপাশি সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে। পাশাপাশি শিল্প উদ্যোক্তরা যদি সহজ শর্তে ঋণও চায় তার ব্যবস্থা করা হবে।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলে ওয়াহিদ খন্দকার বলেন, বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে পাটের চাষ বেশি হয়, সেখানে পাল্প ও কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপন করতে হবে।’ তিনি পাটের ভবিষ্যত চাহিদা পূরণে বছরে দুবার পাট চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য বিজেআরআইর গবেষকদের প্রতি আহ্বান জানান।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘পাটের বহুমুখী ব্যবহারে ভিসকস রেয়ন এবং পাল্প ও পেপার উৎপদানে মনোযোগী হলে আবারো পাটের সোনালী দিন ফিরে আসবে। এজন্য পাট খাতে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে উৎপাদিত পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং ৯৪ শতাংশ সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করে। বাংলাদেশে পাট হতে পাল্পের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ হাজার টন, যার চাহিদা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন নতুন চাষাবাদ পদ্ধতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার আবিষ্কারের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) মহাপরিচালক ড. মো. মনজুরুল আলম বলেন, গাছ থেকে কাগজ তৈরির ফলে সারা পৃথিবীতেই বন ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে। এর ফল হিসেবে পাট হতে পাল্প ও পেপার তৈরির বিষয়ে সকলের আগ্রহ বেড়েছে।
ডিসিসিআইর আহ্বায়ক রাশেদুল করীম মুন্না বলেন, সারা পৃথিবীতে পরিবেশবান্ধব পাটপণ্য ব্যবহারের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই আমাদের পাটপণ্যের প্রসারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্র্যান্ডিং আরো জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই ও পাট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখেন।