আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে এ নিয়ে এখন নানা মহলে চলছে আলোচনা। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোট প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য না আসায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের অন্য উপদেষ্টাদের বক্তব্যে দলটির নীতিনির্ধারকদের মনে নির্বাচন প্রলম্বিত করার সন্দেহ আরও তীব্র হচ্ছে।
মঙ্গলবার রাতে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করছেন, নির্বাচন প্রলম্বিত হলে রাজনৈতিক সংকট বাড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হতে পারে এবং সেটি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে, সেটি এখনই বলা যাবে না। এমনটা হলে পতিত সরকারের লোকেরা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। তারপর তাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কিন্তু তারা এসব কাজে মনোনিবেশ করছে না। ফলে জনগণের মন থেকে নির্বাচন অনিশ্চয়তা কাটছে না।
প্রধান উপদেষ্টা রোববার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ রোডম্যাপ দেওয়া হতে পারে সে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। রোডম্যাপ দেওয়ার পরও নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্বিত হতে পারে- তার এমন বক্তব্য ঘিরে সন্দেহ তৈরি হয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন প্রলম্বিত করার এক ধরনের দুরভিসন্ধি দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন ধরে তাদের মনে এমন সন্দেহের উদ্রেগ হলেও এখন তা আরও তীব্র হয়েছে। নেতারা মনে করেন, সরকারের ভেতরে একটি অংশের দ্রুত নির্বাচন দেওয়া নিয়ে অনীহা আছে। এর ফলে আগামী কয়েক মাসে রাজনৈতিক সংকট বাড়তে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর বিএনপি বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য যে নির্বাচন সেটি থেকে তারা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন কিনা কিংবা ঠিক কতদিন তারা ক্ষমতায় থাকতে চান, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ চায়। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে এ দাবিতে নানা প্ল্যাটফর্ম থেকে সোচ্চার রয়েছে তারা। দলটির নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তারা দেশে একটি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। শুধু বিএনপি নয়, তাদের জোটও দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।
বিএনপি মনে করছে, যতদিন দেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন না হবে, ততদিন আওয়ামী লীগও এই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত রাখবে; দেশি-বিদেশি বন্ধুদের অব্যাহতভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাবে। সেটিও সরকারকে আমলে নিতে হবে। নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা ইস্যুতে বিএনপির অব্যাহত দাবির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষ্যে রোববার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি বলেন, ‘আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। ততদিন পর্যন্ত আপনাদের ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ করব। নির্বাচনি সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে দ্রুত আপনারা নির্বাচনের রোডম্যাপও পেয়ে যাবেন।’
জানা গেছে, বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ড. ইউনূসের এই ভাষণ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা যে বক্তব্য রেখেছেন, সেটি কার্যত বিএনপিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সরকারের বর্তমান অবস্থান নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার অবস্থান বলে দলটির ভেতরে বিবেচিত হচ্ছে।
বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রমে বিএনপির কোনো বিরোধিতা নেই। তারা সরকারকে সহযোগিতা করছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য যেহেতু নির্বাচন, তাই যে সংস্কারগুলো একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত-রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে সেগুলোতে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জাতি নির্বাচনি রোডম্যাপ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়ার আশা করেছিলেন। সেটি পরিষ্কার না হওয়ায় জনগণের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তারা রাজনৈতিক দল হিসাবে এখনো মনে করেন যে, নির্বাচনি রোডম্যাপের ব্যাপারে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) দ্রুত একটি স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারেন।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে বিএনপি নেতাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, সংস্কার এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে বাধা নেই। কিন্তু নির্বাচনের একটি দিন বা সময় ঘোষণা করে সংস্কার কাজ করলে তাতে সুফল আসবে। নইলে এক ধরনের অস্থিরতা লেগেই থাকবে।
রোববার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা সত্যিকার অর্থে শেষ হয় না। তাই এটা বলা অযৌক্তিক যে আমরা সংস্কার সম্পন্ন করব এবং তারপর নির্বাচন করব।