আন্দুলবাড়ীয়ায় রয়েছে পীরে কামেল খাঁজা পারেশ সাহেবের(রঃ) মাজার
নিউজ ডেস্ক:ইতিহাসে দেখা যায় মধ্যযুগে বাদশাহী আমলে বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানির (রঃ) নির্দেশে পূর্ব বাংলায় পীর দরবেশ ও আওলিয়াগণের আগমন ঘটে। জনশ্রুতি রয়েছে সুদূর আরবের পারস্য দেশ থেকে পীর, পয়গম্বর, দরবেশ ও আওলিয়াগণ এসেছিলেন এ দেশে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচার করতে। জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়ীয়ায় রয়েছে পীরে কামেল খাঁজা পারেশ (রঃ), বাগেরহাটের খাঁজা খান জাহান আলী (রঃ), চট্রগ্রামের বয়োজিদ বোস্তামী (রঃ) ও সিলেটের হযরত শাহজালাল (রঃ) অন্যতম।
লোকমুখে শোনা যায়, ৪ জন পীরে কামেল ভারতবর্ষে পদার্পণ করে নদী পথে পূর্ব বাংলায় এসে বিভক্ত হয়ে পড়েন। খাঁজা পারেশ সাহেব (রঃ) ভৈরব নদী পথে পাথরে চড়ে আন্দুলবাড়ীয়ার মিস্ত্রীপাড়ার মসজিদতলা ঘাটে এসে আস্তানা গড়ে তোলেন। এখানে তিনি কিছুদিন অবস্থান করাকালে নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে তোলেন একটি মসজিদ। যা কালের সাক্ষী ও নিদর্শন হিসেবে এ এলাকা মসজিদতলা নামে এখন পরিচিত। এখানে কিছু দিন অতিবাহিত করার পর খাঁজা পারেশ (রঃ) নদী পথে আবারো পাথরে চড়ে ভাটির এলাকা বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। শাহসুফি পীরে কামেল হযরত খাঁজা পারেশ (রঃ) স্থান পরিবর্তন করে প্রায় ৫ শত সাহাবি সাথে নিয়ে খালপথে আন্দুলবাড়িয়া হারদা মৌজার সীমানা রেখায় নির্জন জঙ্গলে আস্তানা গড়ে তোলেন। হযরত খাঁজা পারেশ সাহেব (রঃ) প্রকৃত নাম হযরত আশরাফ আলী। আরব দেশের পারস্য শহর থেকে এখানে আসায় তার প্রকৃত নামের পরিবর্তে পারস্য থেকে খাঁজা পারেশ সাহেব(রঃ) নামে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন। তখন ওই স্থানের নাম ছিলো আশরাফাবাদ। যা কালের বিবর্তনে স্থানের নামকরণ হয়েছে। আন্দুলবাড়িয়া এক খন্ড পাথরের তাইতাদ থেকে পাওয়া যায় পীরের নাম পরিচয় (তাইতাদটি সংরক্ষণে নেই) এখানেই পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচার কালে প্রায় ১০ লক্ষাধিক বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী পীরে কামেল হযরত খাঁজা পারেশ সাহেব (রঃ) এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন।
শান্তির ইসলাম প্রচার করাকালে তিনি এখানেই ইহকাল ত্যাগ করেন। প্রায় ৩৩ বিঘা জমির ওপর পীরে কামেল হযরত খাজা পারেশ সাহবের (রঃ) মাজার, গম্বুজ ঘর, এক খন্ড কালোপাথর, কবরস্থান, ঈদগাহ ময়দান, বিশাল জলাশয়, আন্দুলবাড়ীয়া আশরাফিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, নব-নির্মিত বিলাশ বহুল ৩ তলা বিশিষ্ট জামে মসজিদ, আন্দুলবাড়ীয়া কলেজ ও আন্দুলবাড়ীয়া মুহাম্মাদিয়া দারুল উলূম কওমী মাদ্রাস, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক সুন্দর মনোরম পরিবেশে চারিদিকে সবুজের সমারহ। বিভিন্ন ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছপালা সহ চতুর্দিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। যা চুয়াডাঙ্গা জেলার শ্রেষ্ঠ ও আলোচিত রওজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। যে কেউ প্রকৃতিতে ঘেরা এ তীর্থস্থানের পরিবেশ দেখলেই মুগ্ধ হয়ে পড়েন।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে গভীর বন-জঙ্গলে ঘেরা এ রওজা এলাকাটি অবহেলিত ও অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। জঙ্গলে বাঘ, ভাল্লুক ও জন্ত-জানোয়ারের নিরাপদ বসবাস থাকায় এলাকার মানুষ দিনের বেলায় আশপাশ দিয়ে যেতে ভয় পেতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আন্দুলবাড়ীয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব কাজী আব্দুস সবুর এলাকার সমাজ কর্মীদের সহযোগীতায় সম্পূর্ণ রওজা এলাকাটি বাউন্ডারী প্রাচীর দিয়ে ঘিরে মাজারের সংস্কার করেন। প্রতিদিন দেশের প্রত্যান্ত এলাকা থেকে শত শত নারী-পুরুষ এখানে আসেন রওজা জিয়ারত করতে। অনেকে জঠিল কঠিন রোগ মুক্তি ও বালা মছিবত থেকে মুক্তি পেতে দুই হাত তুলে ফরিয়াদ করেন। রেখে আসেন মাজারে পানি ভর্তি বোতল। কেউ কেউ নিয়ে জান মাটি। এ পানি খেয়ে ও ধুলো মাটি মেখে পীরের ওছিলাতে রোগ এবং বালা-মছিবত থেকে মুক্তি পেলে নিয়তকারীরা দল বেঁধে আসেন নিয়তের মানত শোধ করতে। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারে ছাগল, মুরগী, চাল-ডাল ও নগত টাকা-পয়সা দিয়ে মানতকারীরা নিজ হাতে রান্না করে উপস্থিত ফকির মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করেন।
এক সময় আলেম সমাজ শিরক ও বেদাতের ধুয়া তুলে মাজার এলাকায় রেখে আসা পানি ভর্তি বোতল ভেঙ্গে-চুরে দিয়ে আগতদের বিভিন্ন ভাবে বাঁধা-বিঘœ সৃষ্টি করতো। চোখে দেখা সত্যের অলৌকিক স্বাক্ষী হিসেবে যশোরের ফখরুদ্দিন ফকু বিহারী জঠিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কবিরাজী চিকিৎসায় রোগ নিরাময়ে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে জীবনের মায়া ত্যাগ করে আন্দুলবাড়ীয়ার খাজা পারেশ সাহেবের রওজায় এসে খেদমতে মেতে ওঠেন। ধুলো মাটি মেখে দিন-রাত জিকির আসগার ও প্রার্থনা করে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ী ফেরেন। এ রকমই বললেন, রওজায় উপস্থিত কয়েক জন পরে যশোরে কিছুদিন তিনি অবস্থান করার পর স্ব-পরিবারে পাকিস্তানে চলে জান। তিনি পাকিস্তান থেকে এসে বার্ষিক ইচ্ছালে ছওয়াব-এর রেওয়াজ চালু করেন। (বর্তমানে মৃত) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ফকু বিহারীর ছেলে প্রতি বছরে একদিন আসেন মাজার জিয়ারত করতে। দিয়ে জান উন্নয়নের জন্য নগদ টাকা-পয়সা। জনশ্রুতি রয়েছে এ মাজারে যারাই এবাদত বন্দেগী ও জিকির আজগার করতে এসেছে। তারাই শুনতে পেয়েছে গভীর রাত অব্দি খড়মের ঠকঠক শব্দ। নজরে পড়েছে অলৌকিক অসংখ্য ঘটনাবলী। এলাকায় প্রচলিত আছে রওজার পার্শ্ববর্তী খাল পথ দিয়ে একটি জাহাজ যাচ্ছিল খাজা পারেশ সাহেব (রঃ) ওই জাহাজটি থামার নির্দেশ দেন। সারেং অগ্রাহ্য করায় জাহাজটি সাথে-সাথে বিকল হয়ে যায়। জাহাজ থেকে সকলে নেমে এসে হুজুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। হুজুর মাফ করে দেওয়ার সাথে-সাথে জাহাজটি চালু হয়ে যায়। জাহাজ আরোহীরা হুজুরের আধ্যাতিক শিষ্যত্ব নিয়ে পার্শ্ববর্তী হারদা মৌজায় ৭৫ বিঘা জমির ওপর জনবসতি গড়ে তোলেন। বসতি স্থাপনকারীদের মিয়া উপাধি দেওয়ায় ওই স্থানটি মিয়ার বাগান নামে পরিচিতি পায়। জনশ্রুতি রয়েছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের অন্যান্য স্থানে ক্ষয়-ক্ষতি হলেও আধ্যাত্মিক পিরের উসিলাতে আন্দুলবাড়ীয়া এলাকায় তেমন উল্লেখযোগ্য ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি।
লোকমুখ শোনা যায় তিনি বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করাকালে ইটের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন। মৃত্যুর পর স্বপ্নালোকে তিনি এ মৌজা এলাকায় ইট পোড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আদেশ অমান্য করে মোল্লা আব্দুল হামিদ ও শেখ কায়দার রহমান ইট পোড়াতে গেলে সে ইট পোড়েনি। পীরের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে এলাকার মানুষ এ নির্দেশটি এখনো মেনে চলেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পীরের প্রতি এলাকার মানুষের ভরসা, আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে অগাধ।
ফিরে দেখাঃ হযরত খাজা পারেশ সাহেবের (রঃ) রওজাটি পাঁকা। পবিত্রতা রক্ষার্থে চর্তুদিকে ত্রিশূল রড দিয়ে ঘেরা। গম্বুজ ঘরঃ গম্বুজ ঘরটি কবে কখন কীভাবে তৈরী হয়েছে তা এলাকার কেও বলতে পারে না। গম্বুজ ঘরটি বাদশাহী আমলে নির্মিত। পাতলা টালি, ইট, চুন-শুড়কির গাথুনী দিয়ে তৈরী। কাঁঠের একটি দরজা, অপর প্রান্তে ছোট একটি জানালা। অরক্ষিত অবস্থায় চামচিকা, বাদুর, আর পশু-পাখির অভয়ারণ্য ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সংস্কার করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হযরত খাজা পারেশ সাহেব (রঃ) এ গম্বুজ ঘরে বসে ইবাদাত বন্দেগীসহ জিকির আজগার করতেন। শুনা যায় হুজুরের জিকির আজগার শুনে গভীর জঙ্গলের বাঘ, ভাল্লুক ও জীবজন্তু গম্বুজ ঘরের চারদিক ঘিরে জিকির আজগারে মত্ত হয়ে উঠতো। ইবাদাত বন্দেগীতে আসা জীব-জন্তুদের তিনি কুয়ো থেকে পানি তুলে নিজ হাতে পান করাতেন। কুয়োটি সংরক্ষন করা সম্ভব হয়নি। এখানেই ইবাদত বন্দেগী কালে তিনি শত্রু পক্ষের ইটের আঘাতে শাহাদত বরণ করেন। এক খন্ড কালোপাথরঃ কালো এক খন্ড পাথরে চড়ে খাল পথ দিয়ে এসে এ নির্জন জঙ্গলে আস্তানা গড়ে তোলেন তিনি। কালের স্বাক্ষী হিসেবে মাজারের পাশে রয়েছে সেই কালোপাথরের খন্ডটি। অনেকর বালা মুছিবত থেকে মুক্তি পেতে এ পাথরে চুম্বন করতে দেখা যায়। ঈদগাহ শরিফঃ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার বৃহত্তম ঈদের নামাজ এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। এ ঈদগার জমির পরিমাণ এক একর। গোরস্থানঃ পবিত্র রওজার সাথে রয়েছে প্রায় ২৪ বিঘা জমি। অত্র এলাকার মৃত ব্যক্তিদের ঈদগাহ ময়দানে নামাজের জানাজা শেষে এ গোরস্থানে দাফন করা হয়। জলাশয়ঃ পিরে কামেল খাজা পারেশ সাহেব(রঃ) যে খাল পথে এখানে আস্তানা গড়ে তোলেন। সেই খালটি কালের আবর্তে আজ মৃত প্রায়। খালটির প্রায় দুই একর জমি রওজা ও গোরস্থানের নিজস্ব সম্পদ। আন্দুলবাড়ীয়া আশরিফা দাখিল মাদ্রাসাঃ এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও আলেম সমাজের চেষ্টায় ১৯৭০ সালে এখানে গড়ে উঠেছে আন্দুলবাড়ীয়া আশরাফিয়া দাখিল ও আলিম মাদ্রাসা।
মাঝে খানে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর পুণরায় ২০০৩ সালে চালু করা হয়। ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি আশাতীক হলেও প্রতিষ্ঠানটি প্রায় তিন যুগে অতিবাহীত হলেও এখনো পর্যন্ত এমপিওভূক্ত না হওয়ায় এখানকার শিক্ষক গণ বিনাবেতনে শিক্ষাদান দিয়ে আসছেন। আন্দুলবাড়ীয়া কলেজ: হযরত খাজা পারেশ সাহেবের রওজাকে ঘিরে পাশেই গড়ে উঠেছে এলাকার বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আন্দুলবাড়ীয়া কলেজ। এই কলেজটি ২০০৪ সালে স্থাপিত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ও মনোরম পরিবেশে এই কলেজ ক্যাম্পাসটি যে কেউ দেখলেই মুগ্ধ হন। আয়ের উৎস: বিভিন্ন দান-অনুদান, ফলজ, বনজ ও জলাশয়, বার্ষিক ইজারা দিয়ে। আয়ের সম্পূর্ণ অর্থদিয়ে রওজা ও গোরস্থান সংস্কারে ব্যায় হয়ে থাকে।
উল্লেখ্যঃ আন্দুলবাড়ীয়ার গ্রামে কৃতি সন্তান, ঢাকাস্থ রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিজিএমই’র একাধীকবার নির্বাচিত সহ-সভাপতি, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-কোষাধ্যক্ষ, চুয়াডাঙ্গা জেলার বিএনপির ১নং সিনিয়র যুগ্ম-আহবায়ক ও চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী আলহাজ¦ মাহমুদ হাসান খান বাবু। অনুদান হিসেবে খাঁজা পারেশ সাহেবের রওজা ও কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানটি সম্পৃর্ণ ইট দিয়ে পাঁকাকরণ করে দেন। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী আলী আজগর টগর খাঁজা পারেশ সাহেবের রওজা কেন্দ্রীয় কবরস্থানের বাউন্ডারী প্রাচীর নির্মাণের জন্য অনুদান প্রদান করেন।