নড়েচড়ে বসেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। নতুন করে মাঠ পর্যায়ে তথ্য হালনাগাদ করছে সংস্থাটি। আর এতেই বেড়িয়ে আসছে বিগত সরকারের দলীয়করণের চিত্র। টিসিবির ৮২৭৩ জন ডিলারের মধ্যে ৮ হাজারই আওয়ামী লীগ নেতা।
এক কোটি ফ্যামিলি কার্ড দেওয়া হয়েছে দলীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পছন্দমতো। তাদের কাছে দলীয় ডিলাররাই পণ্য বিক্রি করছেন। অধিকাংশ ডিলারই পলাতক। এ অবস্থায় টিসিবির আঞ্চলিক কার্যালয়, আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের সহায়তায় পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। অপরদিকে ফ্যামিলি কার্ড তথ্য যাচাইয়ে ডিসিদের চার দফা চিঠি দিয়েও জবাব পায়নি টিসিবি।
সারা দেশে কমপক্ষে ১৩টি জেলা ও ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে তথ্য অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে অধিকাংশ ডিলার পলাতক। আওয়ামী লীগের পদধারী হওয়ায় অনেকের নামে মামলা হয়েছে। অনেকে আত্মীয়স্বজন কিংবা স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীর সহায়তা নিয়ে পণ্য তুলে সরবরাহ করছেন। কেউ কেউ বিক্রি করে দিয়েছেন ডিলারশিপ। প্রকৃত ডিলার না থাকায় অনেক জায়গায় পণ্য সরবরাহ বন্ধ আছে। কিছু স্থানে বিকল্প উপায়ে সরবরাহ করছে টিসিবির আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো।
কক্সবাজার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য মেসার্স জাবেদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জাবেদ মোস্তাফা, নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের টেকনাফ উপজেলা সভাপতি সাইফুল ইসলাম এবং টেকনাফ পৌর শ্রমিক লীগের সভাপতি মের্সাস জিয়া এন্টারপ্রাইজের জিয়াউর রহমান দলীয় প্রভাব খাটিয়ে টিসিবি ডিলারশিপ বাগিয়েছেন।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৯নং ওয়ার্ডে যুবলীগ নেতা মাসুদ রানা, ২০নং ওয়ার্ডে যুবলীগ নেতা মাইনুল ইসলাম, ২৫নং ওয়ার্ডে যুবলীগ নেতা এম মিজানুর রহমান মাসুম, ১৪নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক কবির, ২২নং ওয়ার্ডে যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ নুর ই আলম, বরিশাল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মাছুম বিল্লাহ, উজিরপুরে যুবলীগ নেতা মেসার্স আহমেদ জেনারেলের মালিক মো. সুরুজ আহমেদ, বাবুগঞ্জ চাঁদপাশায় আওয়ামী লীগ নেতা মো. কাজল টিসিবি ডিলার। দলীয় পরিচয়ের এই কয়েকজন নমুনামাত্র। তালিকা ধরে যাচাই করলে প্রায় সবার আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা হিসাবে পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।
তবে যোগ্যতা ও নিয়োগের সব শর্ত পালন করেই ডিলারশিপ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) যুগ্মপরিচালক ও মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির। মঙ্গলবার টিসিবির তেজগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয়ে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ডিলার নিয়োগে বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। এসব শর্ত পূরণ করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কে কোন দলের, তা দেখা হয়নি। ফ্যামিলি কার্ড নির্ধারণ নিয়ে তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে জেলা ও উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি আছে। মূলত তারাই এ তালিকা তৈরি করেন। সেক্ষেত্রে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের পছন্দ অগ্রাধিকার পায়। তবে তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রম চলমান আছে। এজন্য আমরা জেলা প্রশাসকদের আইডি, পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রোফাইল খুলে দিয়েছি। অনলাইনের মাধ্যমে তারা প্রত্যেক কার্ডধারীর তথ্য হালনাগাদ করতে পারবেন। কিন্তু আমরা পরপর চারটি চিঠি ইস্যু করেছি। এর কোনো জবাব পাইনি। সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। অপেক্ষা করছি হয়তো চিঠির উত্তর পাব।
তবে ভিন্ন তথ্য ওঠে এসেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাওরান বাজারের প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার কাছ থেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে তিনি বলেন, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৮ হাজার ২৭৩ জন ডিলার নিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে অর্ধেকই নিয়োগ হয় ২০২২ সালে। তড়িঘড়ি করে কোনো যাচাই ছাড়াই আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে এসব ডিলারশিপ ইস্যু করা হয়। এরপর এমপি-মন্ত্রীর ডিও লেটার, প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের তদবিরে নিয়োগ হয় বাকি ডিলার। এককথায় দলের বাইরে কাউকে ডিলারশিপ দেয়নি সাবেক সরকার। সবমিলে আওয়ামী লীগের ডিলারের সংখ্যা ৮ হাজারের মতো। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা মামলা-হামলার ভয়ে পলাতক থাকায় তারা আবেদন করতে পারেননি। আর আবেদন করলেও দেওয়ার সুযোগ ছিল না।
জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ট্রাক সেলের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি। সেসময় ট্রাক এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে পণ্য বিক্রি করত। করোনা মহামারির পর আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এক কোটি ফ্যামিলি কার্ড তৈরি করা হয়। আর এসব কার্ডের বিপরীতে পণ্য সরবরাহে নিয়োগ দেওয়া হয় নতুন করে ৮ হাজার ২৭৩ জন ডিলার। এসব ডিলার নির্ধারিত দোকানে এলাকাভিত্তিক কার্ডধারীদের টিসিবি পণ্য সরবরাহ করে থাকেন। প্রত্যেক কার্ডধারী প্রতিমাসে ১০০ টাকা দরে ২ লিটার ভোজ্য তেল, ৬০ টাকা দরে ২ কেজি মসুর ডাল ও ৩০ টাকা দরে ৫ কেজি চাল ক্রয় করতে পারেন। আজ থেকে ট্রাকে করে ৪০ টাকা দরে আলু বিক্রি করবে টিসিবি। ঢাকা মহানগরীর যে কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৩ কেজি আলু কিনতে পারবেন। অপরদিকে ডিলারদের প্রতি কেজিতে কমিশন দেওয়া হয় ৫ টাকা। তবে প্রকৃত কার্ডধারীদের কাছে পণ্য বিক্রি না করে চুরি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে অবৈধভাবে মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ইনকামের অভিযোগও আছে দলীয়ভাবে নিয়োগকৃত অনেক ডিলারের বিরুদ্ধে।
টিসিবি প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫৭ লাখ কার্ড হালনাগাদ করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র মিলিয়ে তাদের স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি ৪৩ লাখ কার্ড এখনো স্থানীয় প্রশাসন যাচাই করতে পারেনি। এক এনআইডিতে একাধিক ফ্যামিলি কার্ড, এক পরিবারে একাধিক জনের নামে কার্ড, আইডি কার্ড অনুযায়ী মোবাইল নম্বরের অমিল, নতুন ও পুরাতন আইডি দিয়ে পৃথক কার্ড তৈরি, কার্ডের কিউআর স্ক্যান কোড দিয়ে ডুপ্লিকেট কার্ড তৈরির মতো সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় এসব কার্ড স্মার্ট কার্ডে রূপান্তর বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা দেশে ১৪টি আঞ্চলিক কার্যালয় ৮ হাজার ২৭৩ জন ডিলার এবং এক কোটি ফ্যামিলি কার্ড তত্ত্বাবধান করছে। ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের অধীনে মোট ডিলার সংখ্যা ১ হাজার ৭১৮ জন, একইভাবে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ে ২৮৭, খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৫১৫, রাজশাহীতে ৩৮৩, রংপুর জোনে ৬৩১, বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৫০০, দিনাজপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে ২২৩, মৌলভীবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৪২৭, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৮১৭, কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৪৬৭, মাদারীপুর কার্যালয়ে ৪৬৭, ঝিনাইদহ আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৪৬৩, বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৭৭৯ এবং গাজীপুর ক্যাম্প অফিসে ৪৬১ জন ডিলার টিসিবি পণ্য সরবরাহ করে থাকেন।