লোকশ্রুতির সাথে মিল রয়েছে প্রাপ্ত নমুনার : গড়ে উঠতে পারে পর্যটনকেন্দ্র ও যাদুঘর
মেহেদী হাসান, চুয়াডাঙ্গা : দেশের সকল জেলাতে পূরার্কির্তী থাকলেও চুয়াডাঙ্গা জেলায় অদ্যবদি খুজে পাওয়া যায়নি কোন পূরার্কির্তীর নিদর্শণ। দেরিতে হলেও প্রতœত্ববিদদের অনুসন্ধানে কালুপোল গ্রামে গন্ধোপ রায় রাজার ভিটায় সন্ধ্যান মিলেছে পূরার্কির্তীর। মানুষের মুখের কল্পকাহিনী ও জনশ্রুতির উপর ভরকরে পূরার্কির্তী আবিষ্কারে জোরেসোরে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতœত্ববিদরা। বংশ পরাম পরায় শোনা এলাকার মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে নানা কল্প কথা ও চমকপ্রদ কাহিনী। তবে কবে কখন রাজার ভিটাটি নির্মান হয়েছে তা সঠিক ভাবে জানা নাগেলেও স্থানটিতে সেন বংস ও পরে সুলতানী আমল ছিলো বলে ধারণা করা করছে ভূতœতত্ব বিদরা। যতই দিন গড়াচ্ছে ততই আবিষ্কার হচ্ছে নতুন নতুন তথ্য। কৌতুহলী হয়ে উঠচ্ছে এলাকার মানুষ। কালুপোলের রাজার ভিটা দেখার জন্য ভীড় জমাচ্ছে দর্শনার্থীরা। রাজার ভিটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দোকান পাট। আবার কেউ কেউ কল্পকাহিনী ফেঁদে লালসালু বিছিয়ে বসেছে। রাজার ভিটার বিষয়টি এখন এলাকার মানুষের কাছে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
বর্তমানে মানুষ বসত বাড়ি বা স্থাপনা নির্মান করে থাকেন সড়কের কোল ঘেষে। শুধুমাত্র যাতায়াতের সুবিধার্থে। আর সীমানা প্রাচীর দিয়ে থাকেন স্থাপনাগুলো নিরাপদ রাখার জন্য। ঠিক তেমনি মধ্যযুগে রাজা, বাদশা, কাউচ, কুতুব পীর আওলিয়ারা স্থাপনা, প্রাসাদ, উপাশানালয় অথবা রাজকার্য পরিচালনা করার জন্য রাজ দরবার এ জাতীয় স্থাপনাগুলো তৈরী করতেন জলপথের সীমারেখায়। কারণ তখনকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমিই ছিলো নদীপথ। তাই তাদের পছন্দের জায়গা গুলো ছিলো নদীবেষ্টিত কোন নির্জন জায়গা। স্থাপনার চারিদিকের নদী সীমানা প্রাচীর হিসাবে ব্যবহার হতো। তারি আলোকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের কালুপোল গ্রামের গন্ধোপ রাজার রাজ প্রাশাদটি (রাজার ভিটা) গড়ে উঠেছে তিন দিক চিত্রানদী বেষ্টিত জায়গায়।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করে জানাযায়, বারো শতকের দিকে সেন শাসনাধীন বাংলায় সংস্কৃত সাহিত্যের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। এ যুগে শৈল্পিক কৃতিত্বের অপর ক্ষেত্র হচ্ছে ভাস্কর্য নির্মান। চতুদর্শ শতকে সেনযুগে বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের চরম উন্নতি ঘটে। বাংলার ভাস্কর্যের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র ধারাও এ যুগে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুলতানি শাসনামল শুরু হয় তের শতকের সূচনালগ্নে (১২০৪-০৫)। ইতিহাসে সুলতানি আমলের স্থায়িত্ব ছিল ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রায় তিন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে টিকে থাকা এ সুলতানি আমল ইতিহাসের অনেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ এর মধ্যে চলা বাংলার সুলতানি আমল বেশ সমৃদ্ধশালি ছিল। তখন থেকেই বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। তবে এর অনেক আগে থেকেই বাংলার সাথে আরব মুসলমানদের যোগাযোগ ছিল। অবশ্য সে যোগাযোগের স্বরূপ ছিল বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় এবং তা উপকূলীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও অধিকাংশ ইমারতগুলো গড়ে ওঠে নদীর অববাহিকায়। সে দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ভৈরব-কপোতাক্ষ নদ, বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্ত:সীমান্ত নদী। নদীটি ভারতের মুর্শিদাবাদ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার একটি প্রাচীন নদী। পরবর্তীতে ভৈরব মেহেরপুরের পশ্চিম পাশ দিয়ে সুবলপুর গ্রামের কাছে মাথাভাঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। দর্শনা রেলস্টেশনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে ভৈরব নদী মাথাভাঙ্গা নদী থেকে বিচ্যুত হয়ে যশোরে প্রবেশ করে কোটচাঁদপুর পর্যন্ত পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে পরে দক্ষিণমুখী হয়েছে। ভৈরব একটি তীর্থ নদী হিসেবেও পরিচিত। বাংলাদেশে এক নামে একাধিক নদী থাকলেও ভৈরব নামে অপর কোন নদী নেই। ভৈরব নদীর রয়েছে একাদিক শাখা নদী। চিত্রানদী তারি একটি শাকা নদী। সেন বংশের অবশানের পরই সুলতানি আমলের সূত্রপাত হয়। ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে প্যারশ্য স¤্রাজ্য থেকে অনেক ইসলাম ধর্ম প্রচারকের আগম ঘটে। বাংলায় যত ধর্মপ্রচারকের আর্ভিরভাব ঘটেছে তাদের অধিকাংশই ভারত থেকে ভৈরব নদীপথ ধরে বাংলায় আগমন ঘটেছে। তেমনি খুলনা বাগেরহাটের খানজাহান আলী (র:) পারশ্য স¤্রাজ্য থেকে (বর্তমানে উজবেকস্থান) ভারতের নদীপথ ধরে বাংলায় আসেন। খানজাহান আলীর সানিধ্যে থেকে অনেক অনুসারীর সৃষ্টি হয়। তারি অনুসারী ছিলেন গাড়ইটুপি অর্মবতী মেলার মাঠে সমায়িত খাজা মালিক উল গাউছ (র:)। তবে মালিক উল গাউছের মাজার নিয়ে বিশ্লেষকদের রয়েছে ভীন্নমত। গড়াইটুপি অর্মবতী মেলার মাঠে মালিক উল গাউছের শলীল সমাধি হয়নি। এটা তার আস্তানা মাত্র। আর আস্তানাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে মাজার। তার শলীল সমাধী হয়েছে ভারতের বানপুরের মেটেরীতে। জনশ্রুতি আছে মালিক উল গাউছের সাথে বিরোধ বাঁধে রাজা গন্ধোপ রায়ের। বিরোধে গন্ধোপ রায়ের পতন হলে রাজ প্রাসাদ ছেড়ে পরিবারের বাকী সদস্যরা পলিয়ে যায়। তেমনি গন্ধোপ রাজার মেয়ে অর্মবতী ও চম্পাবতী প্রাসাদ ছেড়ে সোনার ডিঙি পালিয়ে যাবার সময় গোষ্টবিহার গ্রামের নিচে চিত্রানদীতে ডিঙি ডুবে তাদের শলীল সমাধি হয়। যা বর্তমানে গোষ্টবিহার গ্রামের করিমের বাড়ির নিচে চিত্রানদীতে ঢিবি আকারে আছে।
কালুপোল গ্রামের নিজাম উদ্দীন (৭৫) বললেন, এই রাজার ভিটার পশ্চিম দিকে রয়েছে উজির ভিটা, উত্তরে ধোপার ভিটা, পূর্বে নাপিতের ভিটা আর দক্ষিণে আছে চিত্রানদী। আর তখনকার মানুষ দক্ষিণ দুয়ারের ঘর বানাতো দক্ষিাণা বাতাস ঘরের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য। রাজার বাড়ির নিকটবর্তী জায়গায় উজির, নাজির দের বাসস্থল থাকবে এটাই সাভাবিক। গন্ধোপ রায় রাজার বহু গৃহপালিত পশু ছিলো। রাজার পতনের পর ওই সমস্থ পশু যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গোষ্টবিহার প্রামে উঠেছে সেই রাস্তায় পশুর পায়ের খুরের আঘাতে দো-আর সৃষ্টি হয়েছে। যা এখনও বিদ্যমান আছে।
৭০ বছর বয়সী আলী মোহাম্মদ বললেন, সোনার ডিঙি নিয়ে পালানোর সময় গন্ধোপ রাজার যে দু’মেয়ে যেখানে ডিঙি ডুবে মারা যায় সে জায়গাটি হচ্ছে গোষ্টবিহার গ্রামের করিমের বাড়ির নিচে চিত্রা নদীতে। সে সময় থেকে সেই জায়গাটি উচু ঢিবি হয়ে আছে। নদীর পানি যখন প্রবাহিত হয় তখন ওই ঢিবির দু’পাশ দিয়ে এখনও পানি যায়। রাজার ভিটার নিচে চিত্রানদীতে এখনও আছে রাজার এবং উজিরের নৌকা বাঁধা ঘাট। যেখানে রাজা ও উজির ডিঙি, নৌকা বেঁধে রেখে প্রাসাদে যেত।
প্রতœতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কাস্টোডিয়ান গোলাম ফেরদৌস বললেন, বর্তমানে রাজার ভিটার মালিকের সাথে একটি মিউচুয়াল যুক্তির মাধ্যমে প্রাথমিক পরীক্ষামূলোক খনণ এবং নমুনা সংগ্রহের কাজ চলছে। প্রাথমিক খণনের পর যে সমস্থ নমুনা এবং উপাত্ত পাওয়াগেছে এ বিষয়টি নিশ্চিত যে এ ভিটায় সেন এবং সুলতানি আমলের লোকজনের বসবাস ছিলো। ১২০৫ সালে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলার সেন রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলায় মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়কার নির্মাতারা নির্মান কাজে যে ধরণের উপকরণ ব্যবহার করতেন যেমন ইট, সুরকি, ঘরের সৌন্ধর্য বৃদ্ধির খেলনাপাতি তারি নমুনা। গবেষণা হয়ে থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন নানা উপকরণের উপর ভিত্তি করে। প্রাথমিক তথ্যে তার সত্যতা মিলেছে। রাজার ভিটাটি সংরক্ষিত পূরার্কির্তী ঘোষনা করার পরই মূল কাজ শুরু হবে। তবে একটি বিষয় সঠিক, রাজার ভিটা নিয়ে স্থানীয় মানুষের মনে যে ভীতি ছিলো তা কেটে গেছে। আর এ ভীতি থাকার কারণেই কিন্তু ভিটাটি নষ্ট হয়নি। তানাহলে কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। চুয়াডাঙ্গা জেলার উপর দিয়ে যে সমস্থ নদীপথ প্রবাহিত হয়েছে সে সমস্থ নদীপথ বার বার বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছে। যার কারণে পূরার্কির্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থান হলেও নদী ভাঙ্গনের ফলে তা নষ্ট হয়েগেছে। তাই রাজার ভিটা আবিষ্কার হলে চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রাচীন ইতিহাস হবে পূর্ন:গঠণ।
প্রফেসর আব্দুল মোহিত বলেন, ১৪১৯ সালে অর্থাত আজ থেকে ৫শ ৯৭ বছর আগে খানজাহান আলী ভৈরব নদী পথে দিল্লী থেকে খুলনা বাগের হাটে আসেন। তিনি খুলনা বাগের হাটে পৌছানোর আগে বারবাজার, যশোহরসহ বিভিন্ন জায়গায় যাত্রাবিরতী করেছেন এবং কিছু না কিছু তৈরী করেছেন। সে সময় খানজাহান আলীর ৪ জন ভক্ত সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে গড়াইটুপির মও.আলী মালিক-উল-গাউছ, মেহেরপুরের মেহেরুল্লাহ শাহ, মুজিবনগর বাগোআনের ফরিদুল্লাহ শাহ এবং আন্দুলবাড়িয়ার আশরাফ আলী। ভক্তদের প্রত্যেককে একটি করে পাথর উপহার দেন তিনি। যা আজও তাদের মাজারে বিদ্যমান। মালিক-উল-গাউছের সাথে গন্ধোপ রায় রাজার বিরোধ সৃষ্টি হয়। তা চুড়ান্তরূপ নেয় এবং তার পতন হয়। পতনের পর রাজার রাজ প্রাশাদটি (রাজার ভিটা) পরিত্যাক্ত হয়। সবচেয়ে বড় প্রমান দৃশ্যমান বস্তুত অস্বীকার করা যায় না। তেমনি রাজার ভিটা দৃশ্যমান এটা অস্বীকার করার কিছুই নেই। আর রাজার ভিটার আশপাশেই উজির, ধূপা, নাপিতের ভিটা থাকাটায় স্বাভাবিক।
বলদিয়া গ্রামের পল্লীচিকিৎসক আজিম উদ্দীন বলেন, ভারত সরকার গোরা কৃষনগর জেলার বামনপুর গ্রামে সেন বংসের শেষ জমিদার বল্লম্ব সেনের একটি বাড়ি মাটির নিচ থেকে আবিষ্কার করেছে। রাজার ভিটায় যে ধরণের নমুনা দেখছি সেখানেও একই ধরণের নমুনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত সরকার সে স্থানটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলেছে। যা টিকিট কেটে দর্শনার্থীদের দেখতে হয়।
তিতুদহ ইউপি চেয়ারম্যান আকতার হোসেন বলেন, রাজাভিটাটি ১৯৬২ সালে গ্রামের মৃত গোলাম রহমানের ছেলে মধু বিশ্বাসের নামে রেকর্ডে হয়ে মালিকানাধীন হয়েগেছে। বর্তমানে মধু বিশ্বাসের ওয়ারেশ গোলাম মোস্তাফারা এ ভিটার দাবিদার। এসএ ১৪২০ দাগে ৮০ শতক এবং আরএস ২০৩৫ দাগে ৮১ শতক রেকর্ড ভূক্তো হয়ে আছে। এ ভিটাটি আবিষ্কার হলে চুয়াডাঙ্গা জেলার সমৃদ্ধ ইতিহাস হবে আরও সমৃদ্ধ। রাজার ভিটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে জাদুঘর, স্থানটি হতে পারে পর্যটনকেন্দ্র। তাই এলাকাবাসীর দাবি ঐতিহাসিক নিদর্শণ রাজার ভিটার কাজ কোন ভাবেই যেন থমকে না যায়।
উল্লেখ্য, ইতিহাস সমৃদ্ধ চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে প্রতœতত্ব ও ঐতিহাসিক নিদর্শণ আবিষ্কারে জরিপ শুরু হয়। এ জরিপে চুয়াডাঙ্গা জেলার ২২৫টি গ্রামের ৯৪টি জায়গায় অনুসন্ধান চালানো হয়। এর মধ্যে ৩টি স্থানকে চিহ্নিত করা হয়। দামুড়হুদার চারুলিয়া, জীবননগরের দৌলতগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গা সদরের কালুপোল গন্ধোপ রায়ের ভিটা। এরিমধ্যে রাজার ভিটায় বেশকিছু নমুনা আবিষ্কার হয়েছে। যার মধ্যে আছে, ধুপচি, লোহার তৈরী বল্মম, মাটির হাড়ি, সারা, কড়ি, পশুর হাড়, হরিণের শিং, মাটির তৈরী পুতুল, প্রদীপ, সানকিসহ নতুন নতুন অনেক কিছু। যা দেখতে প্রতদিনিই দর্শনার্থীরা ভিড় জমাচ্ছে রাজার ভিটায়।