নিহতরা হলেন- চুয়াডাঙ্গা পৌর হাটকালুগঞ্জ এলাকার সুমন হোসেনের ছেলে তাফিম ফেরদৌস (১৭), আলমডাঙ্গার নাগদাহ গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে ও চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের বেলগাছি ঈদগাহপাড়ার মোতালেব হোসেন রনির ভাগ্নে সাকিব হোসেন ডিজে (২০)। সে বেলগাছির একটি আটার দোকানে কাজের পাশাপাশি আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে লেখাপড়া করতো। অগ্নিকাণ্ডে নিহত অপর কিশোর বেলগাছি ঈদগাহপাড়ার সৌদি প্রবাসী শিলন হোসেনের ছেলে ও চুয়াডাঙ্গা একাডেমি স্কুলের ছাত্র সাকিব হোসেন (১৬) এবং চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের শান্তিপাড়ার মৃত শণ্টু ড্রাইভারের ছেলে সাইম হোসেন (১৬)। পরিবারের সদস্যরা জানান, নিহতদের কেউই কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল না।
আরিফিন আলম রঞ্জুর বাড়ির দুজন ভাড়াটিয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুপুর পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। বেলা তিনটার পর হঠাৎ কয়েকজন বাড়ির সামনে এসে জানালায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এসময় তারা জানালা বন্ধ করে দেন। তবে সময় যত যেতে থাকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। বিকেল চারটার দিকে আমরাসহ অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির গ্যারেজে থাকা মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন সিড়িঘরের ছাদ পর্যন্ত উঠে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি এসে আগুন নেভায়, এর আগে বাড়িতে আটকে থাকা কয়েকজনকে অক্ষত উদ্ধারও করে। তবে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জানান, বাড়ির মধ্যে চারটি লাশ পেয়েছে তারা।
স্থানীয়রা জানান, বিকেলে বাড়িতে ভাঙচুরের সময় গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন অনেকে। তবে গুলিতে কেউ হতাহত হয়েছে কি না নিশ্চিত করে কেউ জানাতে পারেনি। ওই বাড়ির প্রতিটি ফ্ল্যাটের বিভিন্ন মালামাল পুড়ে গেলেও বাড়ির ভাড়াটিয়াসহ মালিকপক্ষের কেউ হতাহত হয়নি।
নিহত সাইম হোসেন চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ সড়কের একটি এসি-ফ্রিজ সার্ভিসিংয়ের দোকানে কাজ করতেন। সাইমের মা নাজমা বেগম জানান, গতকাল রঞ্জুর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটের এসি নষ্ট হওয়ায় সেটি মেরামত করতে গিয়েছিল সাইম। এসময় ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলে সে আটকা পড়ে। রাতে ছেলের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত না হলেও সকাল ৯টায় ওই বাড়ির ছাদে গিয়ে ছেলের লাশ সনাক্ত করেন তিনি। বেলা ৩টায় হাসপাতাল মর্গের ডোম ও আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম অজ্ঞাত লাশ দাফনকারী সংস্থার সদস্য আনোয়ার হোসেন নাজমা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে ছাদ থেকে লাশ মর্গে নেয়।
এদিকে তাফিম ফেরদৌসের পরিবারের সদস্যরা জানান, সোমবার দুপুরের পর সমবয়সীদের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হন তাফিম।
এরপর থেকে পরিবারের কারো সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। রাতে আরিফিন আলম রঞ্জুর বাড়িতে চারজনের মৃত্যু ও সেখানে তাফিমের থাকার বিষয়ে জানতে পারে পরিবার। রাত নয়টার দিকে ফেসবুকে মৃতদেহগুলো দেখে তাদের মধ্যে তাফিমকে সনাক্ত করে পরিচিত ও পরিবারের সদস্যরা। এসময় রঞ্জুর বাড়ির ছাদে গিয়ে নিশ্চিত হলে রাত ১১টার পরে তাফিমের লাশ সেখান থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে নেয়। তবে রাতেই আইনি প্রক্রিয়ার জন্য লাশটি পরিবারের সদস্যরা সদর হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায়। গতকাল বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষ তাফিমের লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। গতকাল বাদ মাগরিব নামাজের পর জানাজা শেষে হাটকালুগঞ্জ জান্নাতুল নাঈম কবরস্থানে তার দাফনকার্য সম্পন্ন করা হয়।
মোতালেব হোসেন রনি বলেন, তার ভাগ্নে সাকিব ওরফে ডিজে ছোটবেলা থেকে তার কাছে থেকেই বড় হয়েছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি দোকানে কাজ করতো সে। সোমবার দুপুরের পর রাস্তায় রাস্তায় মানুষ উল্লাস করতে শুরু করলে তার ভাগ্নে সাকিবও বেরিয়ে পড়ে। রাতে সাকিবসহ চারজনের আগুনে পুড়ে মৃত্যুর খবর পান তিনি। পরে রাতেই লাশ শনাক্ত করেন এবং গতকাল সকালে মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে নেয়। তারই প্রতিবেশী সৌদি প্রবাসী শিলন হোসেনের ছেলের নামও সাকিব। গতকাল বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দু’জনে একসঙ্গেই ছিল। অগ্নিকাণ্ডে একই সঙ্গে সাকিবেরও মৃত্যু হয়েছে। মাগরিব নামাজের পর বেলগাছি কবরস্থানে তাদের পাশাপাশি দাফন করা হয়।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ওয়াহেদ মাহমুদ রবিন বলেন, ‘আমিসহ সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. আফরিনা ইসলামকে নিয়ে দুই সদস্যের ময়নাতদন্ত বোর্ড গঠন করে চারটি লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। চারজনেরই শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়াসহ সমন্ত শরীরের উপরের অংশ ঝলসে গেছে। নিহতদের শরীরে গুলি বা গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে ডা. রবিন বলেন, তাদের শরীরে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ জানানো হবে।