স্টাফ রিপোর্টার:
আমিরুল হক রাসেল নামে এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলি স্থগিত করতে লোকজন দিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে অর্ধেক কর্মদিবস অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে এ অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। খবর পেয়ে ছাত্রদল ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গার শিক্ষার্থীরা গিয়ে ওই উপ-পরিচালককে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল হক রাসেলসহ যশোর অঞ্চলাধীন চারজন কর্মকর্তাকে গত ৯ ডিসেম্বর তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আজগর আলী। ওই বদলির পত্রে ১০ তারিখের মধ্যে ছাড়পত্র নিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেলকে মাগুরা জেলার মহাম্মদপুর উপজেলা কৃষি অফিসে বদলি করা হয়। তবে ১০ তারিখ অর্থাৎ গতকাল মঙ্গলবার ছাড়পত্র নেয়ার নির্ধারিত দিনে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে অবরুদ্ধ করার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেলের বিরুদ্ধে। মিটিং এর নাম করে দুপুরের খাবার ও অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লোকজনকে আনা হয় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে।
দুপুরে সরেজমিনে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলি ঠেকাতে সেখানে লোকজন জড়ো হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বলতে পারছেন না কেন তারা সেখানে এসছেন। দুপুরের খাবার দেয়ার সময় সদর উপজেলার আরেক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান ছাত্রদের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ওই দপ্তরে চাকরি করে ওই দপ্তরের কর্মকর্তাকে যারা অবরুদ্ধ করছেন, তাদেরকে কিভাবে খাবার সরবরাহ করছেন এমন প্রশ্ন করছিলেন শিক্ষার্থীরা।
এ সময় ওই কর্মকর্তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেল মুঠোফোনে কল দেন। মুঠোফোনে লাউডে কথা হলে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন ওই উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বদলি হওয়া রাসেলের সাথেই যোগসাজসে আছেন। ওই সময় ওখানে বেশ কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধি ও ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ অভিযোগ তোলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেল আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত। তিনি আওয়ামী লীগের লোকজনকে নানাভাবে সুবিধা দিতেন। আওয়ামী লীগের ইন্ধনেই একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা খবর পায় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। আমরা এখানে এসে দেখি বেশকিছু লোকজন কৃষি অফিসের নিচে এবং দোতলায় অবস্থান করছেন। পরে উপপরিচালকের কক্ষে গেলে দেখি লোকজন একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলির দাবি জানাচ্ছেন। কোনো লিখিত অভিযোগ নয়, লিখিত দাবিও নয়। তারা মৌখিকভাবে বদলি স্থগিত করার জন্য উপ-পরিচালককে চাপ দিচ্ছিলেন। আমরা তাদের সাথে কথা বলি। কথা বলে মনে হয়, তারা কিছু একটা ভুল করছেন বা প্রলোভিত হয়ে এসছেন। পরে আরও ভালোভাবে বিস্তারিত খোঁজ নেয়ার পর দেখা যায়, ওখানে আসা অল্প চার/পাঁচজন বাদে কেউ জানেনই না কেন সেখানে গেছেন। তাদেরকে বোঝানো হয়েছে, একটি মিটিং আছে। দুপুরের খাবার এবং ৩শ থেকে ৫শ টাকা দেয়া হবে। আমরা বিষয়টি অনুধাবন করে তাদেরকে প্রথমে অনুরোধ করি, একটি লিখিত আবেদন দিয়ে যেতে। কারণ, উপ-পরিচালকের বদলির আদেশ স্থগিত করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু যারা এসছিলেন, সকলেই উগ্রতা দেখিয়ে তাদের দাবি মেনে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন। পরে ঘটনাস্থলে ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হলে তাদের সহযোগিতায় বিষয়টি আরও যখন জানার চেষ্টা করা হয়, তখন প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসে। মূলত, টাকা দিয়ে নাটক সাজিয়ে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পরে সকলের পরিচয় জানতে চাইলে ধীরে ধীরে প্রায় সকলেই ওখান থেকে চলে যান।
এসময় প্রকাশ্যে সকলের সামনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে জানান, সদর উপজেলা কৃষি অফিসার আফরিন বিনতে আজিজ তাকে বদলি হওয়া চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেলের বদলি ঠেকাতে অনুরোধ করেছেন। এই অনাকাঙ্খিত ঘটনার সাথে সদর উপজেলা কৃষি অফিসার আফরিন বিনতে আজিজের ইন্ধন দেয়ার বিষয়টি সামনে আনেন তিনি।
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে সদর উপজেলা কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সদর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার আফরিন বিনতে আজিজ দীর্ঘদিন ধরে চুয়াডাঙ্গাতে আছেন। এর আগে তিনি কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। আর তার স্বামী তালহা জুবায়ের মাশরুর দীর্ঘদিন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। এই দুইজন বহু বছর ধরে এই অফিসটির নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার স্বামী বর্তমানে এখানে না থাকলেও প্রভাব আছে। তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে নানা অনিয়ম এবং কর্মচারীদের সাথে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ আছে।
অযৌক্তিক দাবি নিয়ে আসা, কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন ছিলেন হানুরবাড়াদী গ্রামের আবুল কালাম, নেহালপুর গ্রামের সোহেল, কোটালী গ্রামের মোস্তফা আল সাদিক, বেগমপুর গ্রামের ফয়সাল প্রমুখ। সেখানে সরেজমিনে, কয়েকজনকে কি কারণে এসছেন, জিজ্ঞাসা করলে তাদের মধ্যে একজন হেলাল নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমার কুটুম ডেকে নিয়ে এসছে। আমি ইজিবাইক চালাই। কি কাজ জানিনে। বলেছে মিটিং আছে, গেলে দিন-হাজরে দেবে।’
সজিব নামের আরেকজন বলেন, ‘আমাকে গাড়ির ড্রাইভার ডেকে নিয়ে এসছে। কি কাজ জানিনা।’
রুবেল নামের আরেকজন কয়েকজনকে সাথে নিয়ে এসছেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে মিটিং হবে। কৃষি অফিসার নেয়ামত হোসেন আমাকে ডেকে নিয়ে এসছে। আমি তিন/চারজনকে নিয়ে এসছি।’ রুবেল যে কৃষি অফিসার নেয়ামত হোসেনের কথা বলেন, তিনি সদর উপজেলা কৃষি অফিসেরই উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নেয়ামত আলী। তার মুঠোফোনে একাধীক কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি ডিডির অবরুদ্ধ করার খবরে দেখতে গেছি। আমি কারো সাথে নেই। আমি কোনো কিছু করিনি। খাবারও আমি দেয়নি, হোটেলে খোঁজ নেন, কে দিয়ে বেরিয়ে আসবে।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গার আহ্বায়ক আসলাম অর্ক বলেন, ‘আমরা সেখানে গিয়ে এক প্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় পাই জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালককে। একপর্যায়ে আমরা সব ঘটনা শুনি। যারা উপপরিচালককে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, তাদেরকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে গোলযোগ করার জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিলো। ছাত্রদলের সহযোগীতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। এর পেছনে বদলিকৃত কর্মকর্তা আছেন বলেই আমাদের মনে হয়েছে।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব সাফফাতুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা লোকজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তাদেরকে লিখিতভাবে আবেদন বা অভিযোগ দিতেও বলা হয়েছিলো। কিন্তু তারা লিখিত দিবেন না। আবার বদলি স্থগিত না করা হলে যাবেন না বলছিলেন। শেষ পর্যন্ত সকলের সাথে কথা বলে জানা যায়, চার/পাঁচ বাদে যারা এসছেন, তাদের কেউ কেন এসছেন সেটাই জানেন না। খাবার এবং অর্থের লোক দেখিয়ে তাদেরকে আনা হয়েছিলো।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, ‘সদর উপজেলার একজন উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলি স্থগিত করার অযৌক্তিক দাবিতে আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো। আদেশ স্থগিত না পর্যন্ত আমার ওপর চাপট দেয়া হচ্ছিল। পরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের ছেলেরা এসে সকলের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। যারা এসছিলেন, তাদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠানো হয়েছিলো। তবে বেশিরভাগই জানতেন না, কেন এসছেন। দুপুরের খাবার ও টাকার লোভ দেখিয়ে তাদেরকে এখানে আনা হয়। আমরা এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করবো। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘সদর উপজেলা কৃষি অফিসার আফরিন বিনতে আজিজের ইন্ধন আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হবে। তদন্ত কমিটি সেটা নিশ্চয় যাচাই করবে। আমার কাছে একজন ছাত্র প্রতিনিধিও এটি বলেছেন।’
অভিযুক্ত চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেলের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এজন্য তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়াও, সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরিন বিনতে আজিজের মুঠোফোনেও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনিও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।