রাজধানীর বাজারে আরেক দফায় কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা করে বেড়েছে চালের দাম। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে ও পরে পাইকারি বাজারে দর বেড়ে যায়। এখন খুচরা বাজারে সেই প্রভাব পড়েছে।
চাল আমদানি নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখনই এটির দাম বাড়ল। খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ৭ জুলাই চাল আমদানির কথা জানিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। পরে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও সম্মতির খবর আসে। কিন্তু আমদানির খবরে বাজারে দর কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বরং ঘটল উল্টোটা।
ঢাকার খুচরা বাজারে এখন একেবারে কম দামি মোটা চাল প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটু ভালো মানের মোটা চাল কিনতে লাগছে প্রতি কেজি ৪৫ টাকার আশপাশে। মাঝারি মানের বিভিন্ন চাল ৪৭ থেকে ৫০ টাকা কেজি। সরু মিনিকেট চালের কেজি চলছে ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। এ ছাড়া সাধারণ মানের নাজিরশাইল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা ও সেরা মানের নাজিরশাইল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
সব মিলিয়ে বর্তমান বাজারে চালের দাম বেশ চড়া বলা যায়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় মোটা চালের দাম ২২ শতাংশ বেশি। আর সরু চাল ১৫ ও মাঝারি চাল ১০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বোরো মৌসুমের ধান ওঠা শেষে সাধারণত চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। এবার বরং বাড়তির দিকে।
পুরান ঢাকার বাবুবাজার-বাদামতলীর শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক কাওসার রহমান ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের বরিশাল রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন রাজা পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি জানান। তাঁরা বলেন, পাইকারি বাজারে এখন একেবারে মোটা চালের সরবরাহ নেই বললেই চলে। ত্রাণ বিতরণে মোটা চাল চলে গেছে। সব মিলিয়ে সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে।
চালের মূল্যবৃদ্ধির মানে হলো সব মানুষের ওপরই কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, চালের দামের কারণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দেয়।
ছয় সদস্যের পরিবারে তিন বেলা খেতে ঢাকার তালতলার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কামাল হোসেনকে মাসে ৫০ কেজির মতো চাল কিনতে হয়। তিনি বলেন, ‘গত মাসে যে দামে চাল কিনেছি, তার চেয়ে এই দফায় ১৫০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে।’ কামাল বলেন, ‘দাম যতই বাড়ুক, চাল তো কিনতেই হবে। অন্য পণ্য কেনা না হয় কমিয়ে দিলাম।’
কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে বেশির ভাগ চালের দাম
গত বছরের তুলনায় মোটা চালের দাম এখন ২২ শতাংশ বেশি
আমদানিতে মোট করভার সাড়ে ৬২ শতাংশ।
বাজারে শুধু যে চালের দামই চড়া, তা নয়। একটি পরিবারে যা না কিনলেই নয়, সেই সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেরও বেশির ভাগের দাম বাড়তি। যেমন আলুর কেজি এখন ৩৫ টাকা, যা সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে থাকে। বেশির ভাগ সবজির কেজি ৫০ টাকার বেশি। ডিমের দাম চড়া, ডজন (১২টি) ১০০ থেকে ১০৫ টাকা।
অ্যাংকর ডালের দাম কেজিতে ৪ টাকা বেড়েছে। বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। তবে পেঁয়াজ ও রসুনের দাম ঠিকই আছে। বেড়েছে আদার দাম। চিনির দাম দুই দফায় ৪ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৬০ টাকায় উঠেছে।
চালের দাম যে বাড়তে পারে, তার আভাস ঈদের আগেই দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি ছিল, ধানের দাম বেশি। তাই চালের দাম বেশি পড়ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ও অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খুব বেশি চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত চাল সংগৃহীত হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ টনের মতো। এখন সরকারের গুদামে ১০ লাখ টনের কিছু বেশি চাল মজুত আছে বলে জানা গেছে।
চলতি বছর সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সরকার। সে অনুযায়ী চাল না পাওয়ায় আমদানির উদ্যোগের কথা জানায় খাদ্য মন্ত্রণালয়।
দেশে চাল আমদানি নিষিদ্ধ নয়। তবে উচ্চ হারে শুল্ক-কর দিয়ে আমদানি লাভজনক নয়। চাল আমদানিতে এখন ২৫ শতাংশ শুল্ক, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর মিলিয়ে মোট করভার সাড়ে ৬২ শতাংশ। স্থানীয় চাষিদের সুরক্ষা দিতে সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে চাল আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়।
অবশ্য বড় আমদানিকারকদের কেউ কেউ এখন চালের শুল্ক একেবারে কমিয়ে দেওয়ারও পক্ষপাতী নন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের এক আমদানিকারকের মত হলো শুল্ক কমিয়ে দিলে ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল চলে আসবে। তখন আবার কৃষকেরা লোকসানের মুখে পড়বেন।
সাবেক বাণিজ্যসচিব ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নিয়ন্ত্রিত আমদানির পক্ষে। তিনি বলেন, সরকারকে কৃষক ও ভোক্তা—দুই পক্ষের স্বার্থই দেখতে হবে। সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুত থাকতে হবে। সরকার খোলাবাজারে বিক্রি বাড়ালে বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।