চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মো. শরীফুজ্জামান শরীফ বলেছেন, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং চুয়াডাঙ্গায়ও এই ঐতিহ্য অটুট রয়েছে। আমাদের মূল দায়িত্ব হলো— সব ধর্মের মানুষের মাঝে সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং তাদের যেকোনো ধরনের সমস্যার সমাধানে সর্বদা প্রস্তুত থাকা।’
গতকাল শুক্রবার শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময়সভায় এসব কথা বলেন তিনি। শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দিরে বেলা ৩টায় এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ডা. মার্টিন হীরক চৌধুরী।
মতবিনিময় সভায় অতিথি থেকে বক্তব্য প্রদানকালে চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নির্বিঘ্নে তাদের ধর্মীয় আচার—অনুষ্ঠান ও ব্যবসা—বাণিজ্যসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার প্রতিশ্রম্নতি দেন। তিনি দৃঢ়ভাবে আশ্বাস দেন, কোনো অপশক্তি তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না এবং বিএনপি সর্বদা তাদের পাশে থাকবে।
তিনি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যদি কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন, তা তাকে জানানোর জন্য। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, সমস্যা নিয়ে তিনি প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করবেন এবং সমাধানের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই আপনারা নির্বিঘ্নে আপনাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করুন এবং ব্যবসা—বাণিজ্যসহ যেকোনো কাজ শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করতে পারেন। কোনো অপশক্তি যেন আপনাদের কার্যক্রমে বাঁধা দিতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা সচেতন আছি।’
তিনি অভিযোগ করেন যে, বিগত দিনে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা—কর্মী চক্রান্ত করে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে এবং তার দায় বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘বিএনপি সবসময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আমরা কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রকে প্রশ্রয় দেব না।’
নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে আর পূর্বের ন্যায় ভোট চুরির ঘটনা ঘটবে না। সকলেই তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদানের অধিকার পাবেন।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘বিএনপি কারো ওপর জুলুম করার জন্য রাজনীতি করে না, আমাদের রাজনীতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। আমরা সব ধর্মের মানুষের পাশে আছি এবং থাকব।’
তিনি তার বক্তব্যে আরও উল্লেখ করেন, বিগত বছরগুলোতে চুয়াডাঙ্গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শান্তি নষ্ট করতে যখনই কেউ চেষ্টা করেছে, বিএনপির নেতা—কর্মীরা তাদের অপচেষ্টা প্রতিহত করতে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতেও সকল ধর্মের মানুষ যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাদের জীবনযাপন করতে পারে, বিএনপি সে বিষয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবে। বক্তব্য শেষ তিনি আহ্বান জানান, ‘আসুন আমরা একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করি এবং আমাদের সমাজকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ করে আগামীর দেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাই।’
মতবিনিময় সভায় সদর উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হেমন্ত কুমার সিংহ রায়ের পরিচালনায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অ্যাড. রুহুল আমিন।তিনি বলেন, ‘আমরা মুসলিম ধর্মের মানুষ যদি মাঠে, ঘাটে, যেকোনো স্থানে আল্লাহর ইবাদত করতে পারি, তাহলে অন্য সকল ধর্মের অনুসারীরাও তাদের ধর্মীয় আচার পালন করতে পারবেন। আমরা সবাই মানুষ, আমরা সবাই চুয়াডাঙ্গাবাসী। আপনারা কেন নিজেদের সংখ্যালঘু মনে করবেন? আপনারাও এই দেশের সমান অধিকারভুক্ত নাগরিক। আপনাদের যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা—বাণিজ্য করার অধিকার আছে, তেমনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অধিকারও রয়েছে। কোনো ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে আপনাদের কোনো ধরনের বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে না।’
তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘যদি কোনো কারণে আপনারা অনিরাপদ বোধ করেন বা স্বাভাবিক জীবনযাপনে অস্বস্তি অনুভব করেন, তাহলে বলতে চাই, নির্বিঘ্নে আপনাদের ধর্মীয় রীতিতে জীবন অতিবাহিত করুন। আপনাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের।’
অ্যাড. রুহুল আমিন ইসলামের শিক্ষা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের রাসূল (সা.) বলেছেন, যারা সংখ্যায় কম, তারা আমাদের জন্য আমানত। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ইসলামে ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান এবং সুরক্ষা প্রদানের যে নীতি রয়েছে, আমরা তার পূর্ণ অনুসারী।’তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই এই দেশকে সমৃদ্ধ করতে চাই। কিন্তু আমরা যদি সবার আগে মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে না তুলি, তাহলে কখনই দেশের উন্নয়নে আমাদের ভূমিকা রাখতে পারব না। ধর্ম এবং রাজনীতি দুটি আলাদা বিষয়, সকলের নিজ নিজ ধর্মে ধার্মিক হওয়ার অধিকার রাখে। একইভাবে প্রত্যেকে তার নিজের মতো অনুযায়ী রাজনীতি বা রাজনৈতিক পক্ষে অবস্থান করতে পারে। এটি আমার, আপনার সকলের অধিকার।’
মতবিনিময় সভায় পবিত্র গীতা থেকে পাঠ করেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত ঐক্য পরিষদ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নিশিত চক্রবর্তী। স্বাগত বক্তব্য দেন জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার সিংহ রায়। মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন দৈনিক সময়ের সমীকরণ—এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য দেবেন্দ্রনাথ দোবে, পূজা উদ্যাপন পরিষদ জেলা শাখার সাবেক সভাপতি কিশোর কুমার আগরওয়ালা, জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকা ও ডেইলি মর্নিং গ্লোরির জেলা প্রতিনিধি এবং দৈনিক সময়ের সমীকরণ নিজস্ব প্রতিবেদক মেহেরাব্বিন সানভী প্রমুখ।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জেলা শাখার সভাপতিমন্ডলীর সদস্য যাদব কুমার প্রামাণিক, কোষাধ্যক্ষ পলাশ সাহা, যুগ্ম সম্পাদক রাবিন সাহাসহ জেলার নেতৃবৃন্দ।
এসময় আরও বক্তব্য দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জীবননগর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক সাগর কুমার বিশ্বাস, বিজয় হালদার, দর্শনা পৌর কমিটির সভাপতি সমীর কুমার সরকার, সাধারণ সম্পাদক অনন্ত সান্তারা, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা সভাপতি গোবিন্দ প্রামাণিক, আলমডাঙ্গা উপজেলা সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সাধুখা, আলমডাঙ্গা পৌর সভাপতি লিপন বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক পলাশ আচায্যর্সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।