অতীতে বর্তমানের মতো স্টক ও শেয়ারের ধারণা ছিল না, ফলে মুসলমানদের জন্য বিনিয়োগের উপায় নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। আধুনিক ইসলামী পণ্ডিতরা এই সমস্যা বুঝতে পেরে ইসলামের অর্থনীতির নীতির ভিত্তিতে এমন কিছু মানদণ্ড তৈরি করেছেন, যা মুসলমানদের হালালভাবে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়।
যেহেতু কোরআন বা হাদিসে বিনিয়োগের জন্য কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই, তাই বিভিন্ন ‘শারিয়াহ স্ট্যান্ডার্ড’ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ইসলামী অর্থনীতির নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বিনিয়োগের জন্য একটি কাঠামো সরবরাহ করে।
শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড কী?
শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড বলতে এমন নীতিমালা বা দিকনির্দেশনাকে বোঝায়, যা ইসলামী শরিয়াহর (ইসলামী আইন) মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন, চুক্তি এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রণয়ন করা হয়। এটি ইসলামী অর্থনীতি, ব্যাংকিং এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শরিয়া পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহূত হয়।
১. শরিয়াহর পরিপালন নিশ্চিত করা : অর্থনৈতিক কার্যক্রম যেন কোরআন, হাদিস এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। সুদ (রিবা), জুয়া (মাইসির), অনিশ্চয়তা (গারার), এবং হারাম পণ্য থেকে দূরে থাকা।
২. ইসলামী অর্থনৈতিক মডেল প্রতিষ্ঠা : সঠিক, ন্যায়সংগত ও সামাজিক দায়িত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিশ্চিত করা। ঝুঁকি ও মুনাফা ভাগাভাগির ভিত্তিতে লেনদেন চালানো।
৩. মানসিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি : নৈতিকতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। আর্থিক অসদাচরণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধ।
শারিয়া স্ট্যান্ডার্ড কেন প্রয়োজন?
শরিয়া স্টান্ডার্ডের প্রয়োগ ক্ষেত্র
শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড সাধারণত ইসলামিক ফিকহ (ইসলামী আইনশাস্ত্র) এবং ফিকহুল মুয়ামালাত (অর্থনীতির ফিকহ)-এর ভিত্তিতে তৈরি হয়। এগুলো কাজ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন—
১. অর্থনৈতিক চুক্তি ও লেনদেনের নীতিমালা প্রণয়ন
শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড ইসলামী অর্থনীতিতে চুক্তি ও লেনদেনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রদান করে। এগুলো নিশ্চিত করে যে রিবা (সুদ) নিষিদ্ধ থাকবে। গারার (অনিশ্চয়তা) বা জুয়ার উপাদান থাকবে না।
ইসলামী চুক্তি যেমন মুরাবাহা, ইজারা, মুদারাবা, মুশারাকা ইত্যাদি সঠিকভাবে পরিচালিত হবে।
২. বিনিয়োগের নির্দেশনা
শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতির পরিপালন নিশ্চিত করে।
বিনিয়োগের জন্য শুধুমাত্র হালাল খাত বেছে নেওয়া।
নিষিদ্ধ খাতে (যেমন, মদ, তামাক, পর্নোগ্রাফি, অস্ত্র) বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকা।
শরীকি ভিত্তিক বিনিয়োগ যেমন মুদারাবা ও মুশারাকা-কে উত্সাহ দেওয়া।
৩. হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ও অডিটিং
ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শরীয়াহ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী তাদের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ এবং অডিটিং পরিচালনা করে। প্রত্যেক চুক্তি ও লেনদেনের জন্য স্বচ্ছ হিসাব সংরক্ষণ। শরিয়া বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী অডিটিং করা। আর্থিক কার্যক্রম শরীয়াহর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত মূল্যায়ন।
ইসলামী অর্থনীতি শুধু মুনাফার ওপর ভিত্তি করে কাজ করে না, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচার এবং কল্যাণে অবদান রাখার ওপর জোর দেয়।
যাকাত ও সদকা কার্যক্রম পরিচালনা।
সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ।
ওয়াকফ (ইসলামী দাতব্য তহবিল) কার্যক্রম পরিচালনা।
৫. ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (Risk Management)
শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে, যেখানে ইসলামী নীতির পরিপালন নিশ্চিত করা হয়।
তাকাফুল (ইসলামী বীমা) ব্যবস্থার মাধ্যমে ঝুঁকি ভাগাভাগি করা।
গ্রাহকদের সঙ্গে ঝুঁকির স্বচ্ছতা বজায় রাখা।
ফিউচার কনট্রাক্ট এবং ডেরিভেটিভস-এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেন থেকে বিরত থাকা।
৬. শরিয়া বোর্ড পরিচালনা
ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে শরিয়া বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রতিটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম শরীয়াহর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিশ্চিত করা।
ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী চুক্তি ও লেনদেন অনুমোদন।
নতুন আর্থিক পণ্য এবং সেবা শরিয়াহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা যাচাই করা।
৭. সুদমুক্ত অর্থনীতি বাস্তবায়ন
শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সুদমুক্ত নীতিমালা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে।
সুদ (রিবা) পরিহার করার জন্য ইসলামী অর্থনৈতিক মডেল প্রবর্তন।
মুনাফা ও ঝুঁকি ভাগাভাগির ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা।
৮. পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম
ইসলামী অর্থনীতি পরিবেশ রক্ষার উপরও গুরুত্ব দেয়।
পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে বিনিয়োগ।
প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার এবং সংরক্ষণে সতর্ক থাকা।
পরিবেশের ক্ষতি করে এমন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা। যেমন, পরিবেশ সুরক্ষায় Green Sukuk অর্থায়নের একটি ইসলামি উদ্ভাবন।
নির্ভরযোগ্য শরিয়া স্টান্ডার্ড
ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ও সর্বাধিক গৃহীত শরীয়াহ স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে স্বীকৃত এবং উত্তীর্ণ স্ট্যান্ডার্ডগুলো নিম্নরূপ:
১. AAOIFI (Accounting and Auditing Organization for Islamic Financial Institutions)
বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা
AAOIFI হলো ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের জন্য শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়নকারী শীর্ষস্থানীয় সংস্থা। এটি ইসলামী ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০০টিরও বেশি শরিয়াহ, অ্যাকাউন্টিং, অডিটিং এবং গভর্নেন্স স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে।
২. IFSB (Islamic Financial Services Board)
৩. ISRA (International Shari’ah Research Academy for Islamic Finance)
৪. IDB (Islamic Development Bank)
৫. MSCI Islamic Index Series
৬. থমসন রয়টার্স আইডিলিক্স ইসলামিক ফাইন্যান্স ডেটা (Thomson Reuters IdealRatings Islamic Finance Data)
৭. ডাউ জোন্স ইসলামিক মার্কেট ইনডেক্স (Dow Jones Islamic Market Index – DJIM)
৮. জাতীয় পর্যায়ের শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড
অনেক দেশ তাদের স্থানীয় অর্থনৈতিক পরিবেশের জন্য শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে।
মালয়েশিয়া: Bank Negara Malaysia (BNM) এর শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড এর Shariah Advisory Council (SAC) of Securities Commission Malaysia (SC)
পাকিস্তান: স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের Shari’ah Governance Framework
ইন্দোনেশিয়া: DSN-MUI (Dewan Szariah Nasional) এর শরীয়াহ স্ট্যান্ডার্ড।
রাশিয়া : রুশ শরীয়াহ স্ট্যান্ডার্ড (Russia Shariah Standard) রাশিয়ার ইসলামিক ফাইন্যান্স সংস্থা বিশেষত, তাদের নিজস্ব বাজারের জন্য এই স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র : S&P Shariah Indices
মার্কিন সংস্থা ২০০৭ সালে S&P Shariah Indices চালু করে।
কোন স্ট্যান্ডার্ড সর্বাধিক উত্তীর্ণ?
AAOIFI স্ট্যান্ডার্ড সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। AAOIFI-এর স্ট্যান্ডার্ড সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং ইসলামী অর্থনীতির জন্য মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহূত হয়। এটি অন্যান্য স্ট্যান্ডার্ডগুলোর জন্য একটি ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং বাস্তবায়নেও সফল। এটি আন্তর্জাতিক ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয়। এর শরিয়া বোর্ডে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের অংশগ্রহণ থাকে। এটি প্রতিনিয়ত আপডেট এবং নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য উন্নত করা হয়।
IFSB এবং ISRA নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে AAOIFI-এর পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।