দেশে ডায়মন্ডের খনি নেই, আমদানিও হয় না, তবুও থেমে নেই ডায়মন্ডের বেচাকেনা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র হত্যা মামলার আসামি দিলীপ কুমার আগরওয়ালা চোরাই পথে আনা ভেজাল ডায়মন্ডের ব্যবসা করছেন গত দেড় দশক ধরে। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড নামে দিলীপ আগরওয়ালার ২৮টি শোরুম রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। এসব শো-রুমে দিনে বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার ডায়মন্ড।
কোথা থেকে কীভাবে ডায়মন্ড আসছে জানতে চাইলে সদুত্তর দিতে পারেননি ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের বিক্রয়কর্মীরা।
এনবিআর সূত্র জানায়, ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডায়মন্ড ও ডায়মন্ডের গহনা আমদানি হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকার। এর পর দেশে ডায়মন্ডের আমদানি আর হয়নি বললেই চলে। এর বাইরে শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য ২০১৯ ও ২০২০ সালে তিনটি চালান ছাড়া কোনো জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড আমদানি করেনি। ২০২১ সালে অমসৃণ ডায়মন্ড আমদানি করে একমাত্র কাটিং ও পলিশিং কারখানা বেঙ্গল ডায়মন্ড লিমিটেড। কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড আমদানি করে ছোট একটি চালান। ২০২২ সালে দুটি প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড আমদানি করে। শিল্পে ব্যবহারের জন্য বিআরবি কেবল ইন্ডাস্ট্রিজ আমদানি করে একটি চালান। সাড়ে ৫ হাজার ডলার ঘোষণায় আরেকটি চালান আমদানি করে ঢাকার জুয়েলারি হাউস। অর্থাৎ চার বছরে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকার ডায়মন্ড আমদানি হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, আমদানি না হলেও দেশে ডায়মন্ডের বাজার দিন দিন বড় হয়েছে। ডায়মন্ডের গহনা বিক্রির শতাধিক দোকান রয়েছে। এ ছাড়াও কিছু কিছু সোনার দোকানেও ডায়মন্ডের গহনা বিক্রি হয়। এসব দোকানে বছরে কত টাকার ডায়মন্ডের গহনা বেচাকেনা হয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। দেশের ডায়মন্ডের বাজার নিয়ে সমীক্ষা করা একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, ডায়মন্ডের গহনা বেচাকেনা হয় বছরে ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার। গড় বাজার হিসাব করা হলে বছরে তা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে ডায়মন্ড আমদানির সুযোগ নেই। তাহলে দেশের বাজারে বেচাকেনা হওয়া এত ডায়মন্ড কোথা থেকে কীভাবে আসছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আমদানির তথ্যমতে, গত ২০ বছরে যত ডায়মন্ড আমদানি হয়েছে, তার অধিকাংশই ভারত থেকে। ভারতের গুজরাটের সুরাটে বিশ্বের ৬৫ শতাংশের বেশি ডায়মন্ড কাটিং ও পলিশিং করা হয়। খুব সহজে বহন করা যায় বলে দেশটি থেকে অবৈধভাবে ডায়মন্ড আসছে, জানান ব্যবসায়ীরা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচারের সময় কয়েক বছরে কয়েকটি চালান জব্দ করেছেন। ২০২১ সালে সাতক্ষীরা সীমান্তে পৌনে ২ কোটি টাকার ১৪৪টি ডায়মন্ডের গহনা জব্দ করে বিজিবি। ২০১৮ সালে ৭০ লাখ টাকার ডায়মন্ডের গহনা জব্দ করা হয়। অবৈধ পথে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব ডায়মন্ড দেশে আনছিলেন দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। বন্ড সুবিধা ছাড়া অমসৃণ ডায়মন্ড আমদানিতে কর ৮৯ শতাংশ। মসৃণ ডায়মন্ড আমদানিতে কর ১৫১ শতাংশ। এই শুল্ক কর ফাঁকি দিতেই মূলত ডায়মন্ড অবৈধ পথে আনা হচ্ছে। গত ২০ বছরে এই মূল্যবান রত্ন আমদানিতে সরকার নামমাত্র রাজস্ব পেয়েছে। ডায়মন্ডের বাজারে আরেকটি রহস্যজনক আচরণ হলো দেশের বাজারে দাম। এক ক্যারেট (০.২ গ্রাম) ডায়মন্ডের দাম ৭৯ হাজার টাকা। আর সবচেয়ে কম অর্থাৎ শূন্য দশমিক ১০ ক্যারেট ডায়মন্ডের দাম ৭ হাজার ৯১৪ টাকা। বাংলাদেশে নাকফুলসহ ডায়মন্ডের অলংকার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকার নিচে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, হীরার ক্ষুদ্র টুকরা ব্যবহার করা হলেও এত কম দামে ডায়মন্ডের গহনা পাওয়ার কথা নয়। এগুলো আসলে উন্নতমানের কাচের টুকরা। আমদানি না হলেও বছরে এখন গড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ডায়মন্ডের গহনা বিক্রি হচ্ছে দেশে।
ডায়মন্ডের গহনা তৈরি করতে স্বর্ণ ব্যবহৃত হয়। মূল্যবান এই রত্ন বসানো হয় স্বর্ণের ওপর। স্বর্ণ আমদানির জট খুলেছে আগেই। সোনার অলংকারের দক্ষ কারিগরও রয়েছে দেশে। এখন ডায়মন্ড রপ্তানির বৈশ্বিক এই বড় বাজার ধরা গেলে বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আসবে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। এ জন্য নীতিসহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি অবৈধ পথে ডায়মন্ড আমদানি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন তারা।ব্যবসায়ীরা বলছেন, ১০০ গ্রাম পর্যন্ত গহনা আনার সুযোগ নিয়ে ডায়মন্ডের ব্যবসায়ীরা আরও বেশি ওজনের ডায়মন্ডের গহনা নিয়ে আসছে ভারত ও দুবাই থেকে। যদিও ৯০ শতাংশের বেশি ডায়মন্ডের গহনা ভারত থেকে আসছে চোরাই পথে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের উচিত এসব কীভাবে আমদানি হচ্ছে, তার কাগজপত্র চেক করা। তাহলেই তো বেরিয়ে আসবে আসল রহস্য।