সিদ্ধান্ত হয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদল ও তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো.সাহাবুদ্দিনের বৈঠকেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গতকাল মঙ্গলবার রাতে বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর আগে সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জানান, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর অন্তরর্বর্তী সরকার নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে হওয়া বৈঠকে দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির ‘সর্বসম্মত’ সিদ্ধান্ত হয়েছে। খালেদা জিয়া ২০২০ সাল থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্ত আছেন। এখন তাকে কোন প্রক্রিয়ায় ‘মুক্তি’ দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি বঙ্গভবনে মঙ্গলবারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। এদিন বিকালে বঙ্গভবনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সোমবারের বৈঠকের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকেও ‘মুক্তি’ দেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠক হয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করতে বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ সদস্যের একটি দল। এর ঘণ্টা দেড়েক পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিন বাহিনীর প্রধানেরা বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। আধা ঘণ্টা পর বঙ্গভবনে আসেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এ কে আজাদ।
এ সময় এ কে আজাদ বঙ্গভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর হচ্ছে, অগ্নিসংযোগ হচ্ছে। পুলিশ কাজ করতে পারছে না। নিরাপত্তা না দিলে কারখানা চালু করা সম্ভব হবে না। পুলিশ কারখানার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। এরপর রাত ১১টার দিকে বৈঠক শেষ করে বের হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। সমন্বয়কেরা সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে বঙ্গভবন থেকে বের হন। এ সময় গাড়িটির সামনে ও পেছনে সেনাবাহিনীর জিপ দেখা যায়। গতকাল মঙ্গলবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান। রাত ১১টায় সমন্বয়কেরা বের হলেও এই দুই শিক্ষক, তিন বাহিনীর প্রধান ও এ কে আজাদ তখনো বঙ্গভবনের ভেতরে অবস্থান করছিলেন।
এদিকে ভয়েস অব আমেরিকার ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টি মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন। বাকি দুটো মামলায় তার সাজা হয়েছে। এর মধ্যে তিনি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজা ভোগ করছেন। ১৩টি মামলা হয়েছে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে জরুরি শাসনকালে।
মামলাগুলোর মধ্যে পাঁচটি দুর্নীতি মামলা, চারটি মানহানির মামলা ও একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রয়েছে। বাকি মামলাগুলো হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগে। হাইকোর্টের আদেশে ১৩টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ঢাকা, কুমিলস্না ও খুলনায় বেশিরভাগ মামলা হয়েছে। ট্রাস্টের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া ‘অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা’ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেন বিচারিক আদালত। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করলে তা খারিজ হয়ে যায়। একইসঙ্গে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে ১০ বছর কারাদন্ড দেন হাইকোর্ট।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা’ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫। রায়ে খালেদা জিয়াসহ অন্য তিন আসামিকে সাত বছর করে কারাদন্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা করে অর্থদন্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া আপিল করলে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল তা শুনানির জন্য গ্রহণ করে অর্থদন্ড স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এরপর থেকে মামলাটি সে অবস্থায় আছে।