নিউজ ডেস্ক:
বার বার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ব্যবসারত বিদেশি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন সুপারিশ জমা দেয়নি। এ অবস্থায় সাত কর্মদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
সূত্র জানায়, গত ৩১ জুলাই স্টক এক্সচেঞ্জকে এক চিঠির মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে কীভাবে বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করা যায় তার সুপারিশসহ আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে চিঠির উত্তর দিতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশ পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে অর্থবিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এর আগে ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত অুনযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় অতিক্রান্ত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে একইভাবে সুপারিশ চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল।
দেশের পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশে চালু বিদেশি কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারে ছাড়ার জন্য বার বার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন অগ্রগতি হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে সরকারি কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারে ছাড়ার বিষয় নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বাংলাদেশে ব্যবসারত বিদেশি কোম্পানিগুলোর শেয়ার ছাড়ার বিষয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী দেশের শেয়ার বাজারকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সরকারি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকভুক্ত করার ওপর জোর দেন। এ বিষয়ে তিনি একটি বিস্তারিত সুপারিশ পেশের নির্দেশনা দেন।
বিদেশি কোম্পানির মধ্যে ইউনিলিভার পিএলসি’র শেয়ার বাজারে ছাড়ার বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি। দেশের অর্থনীতিবিদরাও বিষয়টির ওপর বার বার তাগিদ দিয়েছেন। বাংলাদেশসহ ১৯০টির মতো দেশে ব্যবসা আছে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার পিএলসির। ব্যবসা পরিচালনাকারী অধিকাংশ দেশের পুঁজিবাজারেই তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি। কিন্তু বাংলাদেশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকা কোম্পানির শেয়ারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাগ দিতে অনিহা মন্ত্রণালয়টির। এ কারণেই ইউলিভারকে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ নেই। যদিও গ্রামীণফোন ও অন্য বহুজাতিক কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত হতে অনেকটা বাধ্য করা হয়।
ভোগ্যপণ্যের বাজারে একক আধিপত্য বিস্তারকারী ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড টার্নওভারের দিক থেকে দেশের তৃতীয় শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটির বার্ষিক লভ্যাংশ প্রদানের হারও ৫০০ শতাংশের ওপরে। এই কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা রয়েছে ৩৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ মালিকানা ধরে রাখতেই কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে যত অনাগ্রহ।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রমতে, ৩৯ দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ারের বিপরীতে প্রতি বছর ভালো লভ্যাংশ পায় সরকার। তাই এ মালিকানা তারা হাতছাড়া করতে রাজি নয়। ইউনিলিভার পিএলসিও নিজেদের হাতে থাকা শেয়ার কমাতে চায় না।
জানা গেছে, ইউনিলিভারকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে বেশ আগেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে ও লভ্যাংশে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুযোগ দিতে কোম্পানিটিকে শেয়ার অফলোডের কথা বলা হয়েছে। তবে শিল্প মন্ত্রণালয় তার কাছে থাকা কোম্পানির ৩৯ শতাংশ শেয়ার হাতছাড়া করতে আগ্রহী নয়।
শেয়ারবাজার বিকশিত করতে ২০০৮ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে শেয়ার ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও সরকারি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে শেয়ার অফলোডের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে ইউনিলিভার ও গ্রামীণফোনসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়। কিন্তু গ্রামীণফোন তালিকাভুক্ত হলেও ইউনিলিভারকে শেয়ারবাজারে আনতে পারেনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। উল্টো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের চাপে বহুজাতিক কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯-এর ইস্যু অব ক্যাপিটালের ২(এ) ধারা অনুযায়ী, দেশী-বিদেশী যেকোনো কোম্পানির মূলধনের ওপর এসইসির কর্তৃত্ব রয়েছে। যে কোনো কোম্পানির ওপর শর্ত, চুক্তি, মেমোরেন্ডাম দেওয়ার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে বিএসইসিকে। তবে ২০১৫ সালের ১১ জুন বিদেশি কোম্পানি ৪০ কোটি বা তদূর্ধ্ব মূলধনি হলে অথবা মুনাফায় থাকলে তাদের তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা বাতিল করে বিএসইসি।
এ বিষয়ে বিএসইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আইন করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির চেষ্টা ছিল। তবে দেশে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এ শর্ত তুলে দেওয়া হয়। বিএসইসি কিছু উদ্যোগ নিলেও অর্থ মন্ত্রণালয় বা সরকারের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ায় ইউনিলিভারসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। তবে এখন সরকার চাইলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
দেশের কোম্পানি আইন অনুুযায়ী কোনো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৪০ কোটি টাকা অতিক্রম করলেই এক বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির জন্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশের তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসতে হয়। কোনো কোম্পানি ওই সময়ে তালিকাভুক্ত হতে না পারলে যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে ছয় মাস সময় বাড়াতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বীমা কোম্পানির জন্য প্রতিদিন এক হাজার টাকা হারে জরিমানার বিধান রয়েছে। বিদেশি কোম্পানির জন্য এ ধরনের বাধ্যবাধকতা নেই। অবশ্য মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো লাভজনক হওয়ার পর পুঁজিবাজারে আসার শর্ত রয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকার শেয়ারবাজারে ২৯৬টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৪১টি বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে। আর পূঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মাত্র ১১টি বহুজাতিক কোম্পানি, যা বাজার মূলধনের মাত্র সাত শতাংশ।