তীব্র বন্যার কবলে পড়েছে দেশের ১১ জেলা। এ সব জেলার অন্তত ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ৫৩৫ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আকস্মিক বন্যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে বিপাকে পড়েছে তারা। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে ১১ লাখ গ্রাহক।
শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বন্যায় মোট ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় চারজন, ককক্সবাজারে তিন, চট্টগ্রামে দুই এবং ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একজন করে রয়েছে।
এদিকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে অনেক মানুষ।
পানিবন্দি হয়ে জেলার কয়েক লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বানভাসী মানুষকে উদ্ধারে কাজ করছে সেনা ও নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গতকাল সকালে ফেনী সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ স্থানেই পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলের জমি।
অনেক গ্রামে বাড়িঘর খালি পড়ে আছে। বেশির ভাগ ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকেছে। কেউ কেউ দোতলা ও তিন তলায় আশ্রয় নিয়েছে। ভেসে গেছে বেশির ভাগ পুকুর ও জলাশয়ের মাছ। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও বুক সমান পানি। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে অনাহারে দিন কাটছে অনেকের। ত্রাণের অপেক্ষায় দিন কাটছে কারো কারো।
এদিকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে কুমিল্লায়। ভারত থেকে আসা পানি ও কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বুড়িচং উপজেলায় গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে ৯টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষ।
গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামের কাছে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। গতকাল দুপুর ২টার মধ্যে পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়ে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান জানান, গতকাল বিকেল ৩টায় গোমতীর পানি বিপৎসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
গাজীপুর গ্রামের সালমা হক বলেন, ‘আমাদের বাসার মালপত্র ছাদের ওপরে রেখেছি। পানি বাড়ছে। আমার মাকে নিয়ে কুমিল্লা শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া সড়কে পানি ওঠায় যান চলাচল বন্ধ। বলতে গেলে চরম দুর্ভোগে পড়েছি। এলাকার সব বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। ’
হবিগঞ্জের নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ডুবছে জেলার নিম্নাঞ্চল। জেলার পাঁচটি উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের আট হাজার ২৪০টি পরিবার আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। আক্রান্ত উপজেলাগুলো হলো চুনারুঘাট, মাধবপুর, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ।
গতকাল বিকেল ৩টায় হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, চুনারুঘাট উপজেলায় খোয়াই নদীর বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। শায়েস্তাগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৩৩ সেন্টিমিটার ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মাছুলিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল পানি। এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার, বানিয়াচং মার্কুলি পয়েন্টে পাঁচ সেন্টিমিটার এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কালনী নদীতে ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে।
আখাউড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গতকাল দুপুর থেকে পানি কমে গেছে। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।
এদিকে পানি কমলেও স্রোতের তোড়ে আখাউড়া-কসবা সড়কের দেবগ্রাম ও নয়াদিল এলাকাকে ভাগ করা একটি ছোট সেতুর এক পাশ ধসে যায়। এই অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আখাউড়ার সঙ্গে কসবা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া পৌর এলাকার দেবগ্রামে নতুন নির্মাণ হওয়া আরেকটি সেতুর সড়কের পাশ থেকে মাটি সরে গেছে।
আখাউড়া স্থলবন্দর এলাকার কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পানি কমে গেছে। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, কম্পিউটারসহ ইলেকট্রনিক ডিভাইস ঠিকঠাক থাকলে দু-এক দিনের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
মিরসরাইয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল ও ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে ওঠায় কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। বৃহস্পতিবার রাতে হালদা নদের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানির তীব্রতা আরো বাড়ে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে পানি ওঠায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা যানবহান আটকে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকামুখী লেন ব্যবহার করতে না পারায় উদ্ধারকাজেও বিঘ্ন ঘটছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটছে।
জোয়ারের পানির চাপে পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধের কমপক্ষে ৩০০ ফুট জায়গা ভেঙে যাওয়ায় ছয়টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। ২২ নম্বর পোল্ডারের গোটা দ্বীপটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন গতকাল স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ আটকানোর চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেনি। এতে ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের ও আমনের বীজতলা।
কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে কুলাউড়া উপজেলায় মনু নদের বাঁধে তিনটি স্থান ভেঙে টিলাগাঁও ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার পর নতুন করে আরো অর্ধশতাধিক গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। প্লাবিত হয়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলের জমি। এদিকে ঢল ও জুড়ী নদীর পানি হাকালুকি হাওরে প্রবেশ করায় হাওরের পানি ক্রমেই বাড়ছে। পানি ঢুকেছে কুলাউড়া পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে। উপজেলা পরিষদ সড়কে রয়েছে হাঁটুপানি।
মৌলভীবাজার পাউবো জানিয়েছে, গতকাল সকাল ৯টার তথ্যানুযায়ী মনু নদের পানি হাজীপুর ইউনিয়নের রেল ব্রিজ এলাকায় বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সন্ধ্যা ৬টায় ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জুড়ী উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত জুড়ী নদীর পানি ১৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কুলাউড়া ক্যাম্পের একটি টিম স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দুর্গত মানুষকে উদ্ধারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
কাদিপুর ইউনিয়নের উত্তর কৌলা গ্রামের আউয়াল মিয়া বলেন, ‘মনু নদে ভাঙনের কারণে আমার বাড়ির উঠানে পানি। পানি বাড়লে যেকোনো সময় ঘরে প্রবেশ করবে। ২০০৪ সালের পর এই প্রথম এমন ভয়াবহ বন্যা হলো। ’
চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের ভেতরে এখনো জলাবদ্ধতা দূর হয়নি। ফলে প্রকল্পের ফরিদগঞ্জ উপজেলার শতাধিক গ্রামের নিম্নাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে আছে। একই পরিস্থিতি চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব উত্তর ও দক্ষিণ, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি ও কচুয়া উপজেলার নিম্নাঞ্চলে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার পুকুর, ৫০টি বিল ও ঝিলে মাছের খামার রয়েছে। টানা ভারি বৃষ্টির কারণে এসব খামার থেকে মাছ ভেসে গেছে।
চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ২০টি বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এদিকে বরইতলী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পহরচাঁদা এলাকায় পানিতে ডুবে মারা গেছে মোহাম্মদ হাবিব (১৩) নামের এক শিশু। সে ওই এলাকার মো. জসীম উদ্দিনের ছেলে।
ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের কারণে লক্ষ্মীপুরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগ বেড়েছে। তবে গতকাল থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। যদিও এই সময়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। রামগতি, কমলনগর, রায়পুর, রামগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর সদরের ছয় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে কষ্টে রয়েছে। অনেকের বসতঘরও পানিতে ডুবে আছে। চারপাশে থইথই পানি। কমলনগরের চর কাদিরা ইউনিয়নের সর্বত্র এখন চার ফুট পানির নিচে। ভুলুয়া নদীর দক্ষিণ প্রান্তে আজাদনগর স্টিল ব্রিজ এলাকাসহ বিভিন্ন অংশে দখলের কারণে আশানুরূপভাবে পানি নামছে না।