লেখনির মাধ্যমে অতিবাস্তবতাকে বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশ্বে যে ক’জন সাহিত্যিক নন্দিত এবং প্রসিদ্ধ, তাদের মধ্যে অন্যতম ইংরেজ কবি কোলরিজ। তিনি নাটক-উপন্যাস-চলচ্চিত্রে সর্বদাই অতিবাস্তবতাকে যৌক্তিক করে তুলেছেন। ১৭৭২ সালে এই কবির জন্ম। অথচ এখনো তার সকল সাহিত্যকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে। আগ্রহীরা এখনো তাকে অধ্যয়ন করতে পারেন, তাকে গবেষণা করতে পারেন। তার সাহিত্যকর্ম এতো বছর পরেও সহজলভ্য।
গত শতকে এই বঙ্গে যে কয়েকজন সাহিত্যিক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, মীর মশাররফ হোসেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গদ্যের ঊন্মেষকালে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। অনেকে তাকে ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলমান গদ্যশিল্পী’ বলে অভিহিত করেন।
‘বিষাদ-সিন্ধু’ কিংবা ‘জমীদার দর্পণ’-এর মতো ধ্রুপদী-সাহিত্যের স্রষ্টা মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) ঊনিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ লেখক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-প্রয়াসের সার্থক সূচনা তাকে দিয়েই। শিল্পীব্যক্তিত্ব মশাররফ ছিলেন নব্য-উত্থিত মুসলিম মধ্যশ্রেণির প্রধান সাংস্কৃতিক মুখপাত্র। মুক্ত মন, উদার শিল্পদৃষ্টি, সমাজমনস্কতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা তার জীবন ও সাহিত্যচর্চায় যেমন, সাময়িকপত্র-পরিচালনার ক্ষেত্রেও তেমনই প্রতিফলিত হয়েছে। মশাররফের সাহিত্যজীবনের সঙ্গে তার সাংবাদিকতা-কর্ম ও সাময়িকপত্র-সম্পাদনার যোগসূত্র অত্যন্ত গভীর। সাহিত্যের মতো সাময়িকপত্র-প্রকাশনার মুসলিম-উদ্যোগের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা পথিকৃতের।
মীর মশাররফ হোসেন ঊনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তার প্রথম জীবনীকার ব্রন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় তাকে বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মীর মশাররফ হোসেনকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করা হলেও অসঙ্গত হয় না। গদ্যে, পদ্যে, নাটক, নভেলে মীর মশাররফ হোসেন অনেক (সংখ্যাবিভেদ রয়েছে) গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গদ্যরীতি ছিল বিশুদ্ধ বাংলা যা তদানীন্তনকালে অনেক বিখ্যাত হিন্দু লেখকও লিখতে পারেন নি। তবে তাঁর পদ্যনীতি প্রায় সবই অনুকৃতি ও কষ্টকল্প রচনা বলে তেমন সমাদর পায়নি। তিনি ‘জমীদার দর্পণ’ নাটক লিখে তদানীন্তনকালে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের মর্যাদা লাভ করেন।
হতাশার কথা হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী ধারার যিনি প্রবর্তক, তার সকল সাহিত্যকর্ম আমাদের সংগ্রহে নেই। এমনকি মীর মশাররফ হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা নিয়ে যে বিভ্রান্তি রয়েছে, তারও কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই।
উইকিপিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এখন পর্যন্ত মীর মশাররফ হোসেনের মোট ৩৬টি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়’। প্রকাশের তারিখ অনুসারে সেগুলোর তালিকাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বিভিন্ন স্মারক গ্রন্থে ‘উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য, গীতি নাট্য, প্রবন্ধ, সাহিত্য, সমাজ চিত্র প্রভৃতি নানা বিষয়ে তার প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত মিলে মোট ৩৫টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র বলছে, ‘সব মিলিয়ে মীর মশাররফ হোসেনের গ্রন্থের সংখ্যা ৪০’।
২০১২ সালে প্রকাশিত ‘মীর মশাররফ হোসেন স্মারকগ্রন্থ’-এ তার গ্রন্থসংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৩৭। এসব গ্রন্থের নামও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মীর মশাররফ হোসেনের অবদান অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অমর স্রষ্টা। বাংলার মুসলমান সমাজের দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর জড়তা দূর করে আধুনিক ধারায় ও রীতিতে সাহিত্য চর্চার সূত্রপাত ঘটে তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে। তাঁর সৃষ্টিকর্ম বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করে। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘বিষাদ সিন্ধু’। মহররমের বিষাদময় ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে তাঁর রচিত মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস ‘বিষাদ-সিন্ধু’ আমাদের ইতিহাস ও সাহিত্যের এক স্থায়ী ও অমূল্য সম্পদ।
কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা সর্ববৃহৎ এই উপন্যাসটি মীর মশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ রচনা। সেই ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি প্রায় ১৩১ বছর ধরে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে সমাদৃত আসন দখল করে আছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের সঙ্গে দামেস্কের অধিপতি এজিদের বিরোধ ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে প্রধান ঘটনা। তার এই বিখ্যাত গ্রন্থ তাকে বাঙালি পাঠক সমাজ তথা মুসলিম বিশ্ব চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। ধর্মীয়ভাবেও গ্রন্থটি বিখ্যাত। কিন্তু এতো বছরেও বইটি সরকারিভাবে প্রকাশের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যা নিতান্তই দুঃখজনক।
মীর মশাররফ হোসেন আধুনিক মুসলিম সাহিত্যের অগ্রসৈনিক। তিনি বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করেন। তাঁর পূর্বে কোনো মুসলমান সাহিত্যিকই এত বিপুলভাবে সাহিত্যক্ষেত্রে অগ্রসর হননি। তিনি সাহিত্যের সকল শাখায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এদিক থেকে তিনি মুসলিম জাগরণের পথিকৃৎ। কিন্তু এই অগ্রদূতের প্রতি আমরা কোনো দায়িত্ব পালন করিনি। জাতীয়ভাবেও নয়।
১৯১১ সালে ১৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সোমবার এই সাহিত্য সম্রাটের মৃত্যুবার্ষিকী। ১১৫ বছরে কোনো সাহিত্য সম্রাটের লেখা হারিয়ে যেতে পারে না। বাংলা একাডেমি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন প্রাচীন নির্দশন সংগ্রহ করে। এই গদ্যশিল্পীর সাহিত্যকর্ম সংগ্রহ করাও নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। প্রকল্প গ্রহণ করেও এ ধরনের মহতী কাজগুলো করা যেতে পারে। কিংবা জাতীয়ভাবে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিসংগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেও তার সকল সাহিত্যকর্ম সংগ্রহ করা যেতে পারে। কারণ, এসব মনীষী শতাব্দিতে গুটিকয়েক জন্মায়। তাদের যোগ্য সম্মান দিতে হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেকটা পিছিয়ে আছি।