জাহিদুর রহমান তারিক,ঝিনাইদহঃ
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে হুন্ডি সমস্যার সমাধান দীর্ঘ ১৮বছরেও হয়নি। অগনিত মানুষ হুন্ডি কাজলের ফাঁদে পা দিয়ে সহায় সম্বল হারিয়ে কেউ কেউ করেছেন মৃত্য বরণ, যারা বেঁচে আছেন। তারা কাতরাচ্ছেন নিরব যন্ত্রণায়। অথচ অসহায় মানুষের টাকায় হুন্ডি কাজল ভারতের বনগাঁ থানার চাদপাড়া এলাকার তার এক আত্মীয় স্কুল শিক্ষক ফজলুর রহমানের নামে হাবড়া থানার বামনগাছী গ্রামের মুন্সিপাড়ার ফকির সাহেবের বাড়ীর পাশে জমি ক্রয় করে বিশাল বাড়ী করেছেন যা দ্বিতীয় তলার কাজ চলছে। সেখানেই চালিয়ে যাচ্ছেন একাধিক ব্যবসা। ঢাকাতে ছেলে মেয়েদের নামে কিনেছেন ফ্লাট। কোটচাঁদপুর ও জীবননগরে স্ত্রী ও সন্তানদের নামে হুন্ডি ব্যবসা চলা কালিন সময়ে ক্রয়কৃত সম্পত্তি ইতি মধ্যে চুপিসারে বিক্রয় হয়ে গেছে। এব্যাপারে কাজলের স্ত্রী শামিমা আহমেদ রেটিনা এ প্রতিবেদককে বলেন, সেতো (কাজল) টাকা দিয়ে দেবে বলছে। তবে তার মামলা চালাতে গিয়ে জমি বিক্রি করতে হচ্ছে। জমি বিক্রি করে মামলা চালালে লগ্নিকারীদের টাকা কোথা থেকে দেবে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন। হুন্ডি কাজলের তিনটি চেক ও একটি “হুন্ডি ব্যবসায় টাকা আত্মসাতের” মামলায় মোট ১৮ বছরের জেল হওয়ায় সে ফেরারী জীবন যাপন করলেও ইদানিং আবারো টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে কাজলের নামে’র সম্পত্তি হুন্ডি এজেন্টদের মাধ্যমে বিক্রি’র পাঁয়তারা চালাচ্ছে তার স্ত্রী । সে কারণে মাঝে মধ্যে কাজলের স্ত্রী কোটচাঁদপুরে অবস্থান করছেন।
এভাবেই হুন্ডি কাজল অবৈধ হুন্ডি’র টাকায় কেনা কোটচাঁদপুর ও জীবননগরের সম্পত্তি বিক্রি করতে করতে প্রায় সাবাড় করে ফেলেছেন। তার পরিকল্পনা রয়েছে এখান থেকে জমি সম্পূর্ণ বিক্রি’র পর সর্ব শেষ ঢাকার ফ্লাট বিক্রি করে স্ত্রী পূত্র কন্যা নিয়ে ভারতে পাড়ি জমানো। এদিকে, কাজলের অবৈধ হুন্ডি’র টাকায় তার আর্শিবাদ পুষ্ট কয়েকজন এজেন্ট’র নামে ক্রয়কৃত প্রায় দুই’শ কোটি টাকার সম্পত্তি ভোগ দখলে করছে ওই সকল এজেন্টরা। অথচ কোটি কোটি টাকা হাতানো এই প্রতারক হুন্ডি কাজল ও তার সহযোগীরা রয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’র ধরা ছোয়ার বাইরে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শহরের সলেমানপুর গ্রামের আব্দুল মাজেদ ও তার ভাই পিকুলে’র নামে হুন্ডি ব্যবসা চলাকালিন সময়ে কাজলের ক্রয়কৃত সম্পত্তি রয়েছে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ কোটি টাকার। তাছাড়া হুন্ডি কাজল ও উক্ত মাজেদের নামে রয়েছে যৌথ একাউন্ট। সূত্র জানায়, ওই একাউন্টে ২০০০ সালে ৮ কোটি টাকা রাখা হয়। পরবর্তীতে মাজেদের সাথে কাজলের বনিবনা না হওয়ায় টাকা গুলি থেকে যায় ওই একাউন্টে। যা বর্তমানে বেড়ে দাড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকায়। যদিও মাজেদ তার সাথে কাজলের যৌথ একাউন্টে’র কথা অস্বীকার করেছেন। অপর একটি সূত্র জানায়, হুন্ডি চলাকালিন সময়ে কোটচাঁদপুর কৃষি ব্যাংকে মাজেদের একাউন্টে ৭৫ লাখ টাকা রাখে কাজল। হুন্ডি ধ্বস নামার পর সুযোগ বুঝে ২০০১ সালে ওই টাকা একাউন্ট থেকে তুলে নেয় মাজেদ। এ ছাড়াও মুড়ি আজিজ, রশিদ সরদার, মোজাম্মেল, মফিজসহ বেশ কয়েকজনের নামে কাজলে’র হুন্ডি’র টাকায় কেনা রয়েছে এক’শ কোটি টাকারও অধিক সম্পত্তি। যা এখন নিজেরাই মালিক সেজে ভোগ দখল করছেন। যে কারণে ভূক্তভোগীরা বিগত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমে’র দিয়ে যাওয়া কথা রক্ষা ও প্রতারক হুন্ডি কাজলকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং তার সহযোগীদের (হুন্ডি এজেন্ট) সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ওই সম্পত্তি বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রতারিত গ্রাহকদের মাঝে বিতরণসহ ওই সকল অপরাধীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি’র জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রি’র হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে কোটচাঁদপুর শহরের সলেমানপুর গ্রামের মৃত পচা মিয়ার ছেলে ফারুক আহম্মেদ কাজল হুন্ডি ব্যবসা শুরু করে। ১৯৯৮ সালের দিকে কাজলে’র হুন্ডি ব্যবসা প্রকাশ্যরুপ নেয়। পরের বছরের প্রথম থেকে কোটচাঁদপুর এলাকার অধিকাংশ মানুষ সহায় সম্বল বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা কাজলের কাছে তুলে দেয়। লাখে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ দেয়ায় বিষয়টি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ কাজলের হুন্ডিতে লগ্নি করতে কোটচাঁদপুরে ছুটে আসে পঙ্গ পালের মত। এটা প্রকাশ্য আইন প্রয়োগকারী সকল সংস্থার সামনেও এব্যবসা চলার পাশাপাশি হুল্ডি কাজল তার এ ব্যবসা বৈধ বলে নিজে ও তার সহযোগীদের দ্বারা প্রচার করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে লভ্যাংশ দেয়ায় লগ্নিকারীদের আস্থা ভাজনে পরিণত হয় হুন্ডি কাজল। যে কারণে ২০০০ সালে’র জানুয়ারী থেকে ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে হুন্ডি কাজল ৭ থেকে ৮ শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। মার্চ মাস থেকে হুন্ডি ব্যবসায় ধ্বস নামে। ফলে হুন্ডি কাজল লভ্যাংশে’র টাকা প্রদানে গড়িমসি শুরু করলে লগ্নিকারীদের মধ্যে সন্দেহ ঘনিভূত হতে থাকে। সেই সাথে গ্রাহকরা লগ্নিকৃত টাকা তুলে নেয়ার জন্য কাজলের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।
কিন্ত হুন্ডি কাজল লগ্নিকারীদের টাকা ফেরত প্রদানে ব্যার্থতার পরিচয় দিলে ৮মে কোটচাঁদপুরে শুরু হয় ভয়াবহ পরিস্থিতি। হাজার হাজার লগ্নিকারী উত্তেজিত হয়ে শহরে ব্যাপক ভাংচুর শুরু করে। প্রতারক হুন্ডি কাজল ও তার এজেন্টদের বাড়িঘর দোকানপাটে ব্যাপকভাবে ভাংচুর চালায় লগ্নিকারীরা। এ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কিছু সুযোগ সন্ধানী ব্যাক্তি এ সময় লুটপাট চালায়। ওই দিন কাজলকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কাজলের গ্রেফতারের পর কোটচাঁদপুরে হরতাল ভাংচুর অপহরণ অব্যাহত থাকায় ২০০০ সালে ৫জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আসেন কোটচাঁদপুরে। বয়েজ হাইস্কুল মাঠে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম লগ্নীকারীদের উদ্দেশ্যে জনসভায় বলেছিলেন, আপনারা শান্ত হোন, কাজল ও তার এজেন্টদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে লগ্নিকারীদের লগ্নিকৃত টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করা হবে। অপরাধীরা ৪০ হাত মাটির নিচে থাকলেও সেখান থেকে তাদেরকে বের করে আনা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কথায় লগ্নকারীরা শান্ত হয়। কথা রাখেন লগ্নিকারীরা। কোটচাঁদপুর উত্তপ্ত শহর শান্ত হয়ে আসে। অথচ কথা রাখেনি সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ১৮ বছর অতিবাহিত হতে চললেও এ সমস্যা’র আজও সমাধান হয়নি।