রবিবার, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫
রবিবার, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫

হাদিসের আলোকে শিরকাত বা অংশীদারিত্ব!

নিউজ ডেস্ক:

প্রশ্ন : নবী (সা.) এর বাণী দ্বারা কী শিরকাত প্রমাণিত হয়? বিস্তারিত জানতে চাই।
উত্তর : নবী করিম (সা.) এর কথা ও কাজকর্ম উভয়টি থেকেই শিরকাত বা অংশীদারিত্বের বৈধতা ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে এর দ্বারা সফলতা কীভাবে আসবে, তাও প্রমাণিত হয়।
হাদিস নং-১ : হাদিসে কুদসি : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি দুই অংশীদারের মধ্যে তৃতীয় অংশীদার হই, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের কেউ খেয়ানত না করে।’ (আবু দাউদ)।
আর ‘দারা কুতনি’র বর্ণনায় আছে, ‘যখন তাদের একজন অপরজনের সঙ্গে খেয়ানত করে, তখন তা বিনষ্ট হয়ে যায়।’ অর্থাৎ খেয়ানত করার কারণে বরকত চলে যায়।
এ হাদিসের মধ্যে শুধু যৌথ লেনদেনের বৈধতার কথা বলে শেষ করা হয়নি; বরং এর প্রতি যথেষ্ট অনুপ্রেরণাও দেয়া হয়েছে এই বলে যে, যতদিন পর্যন্ত অংশীদারদের মাঝে খেয়ানত হবে না, ততদিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সঙ্গে থাকবেন এবং বরকত দানসহ তাদের হেফাজত করবেন।
হাদিস নং-২ : নোমান ইবনে বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে লোকের ওপর যৌথ সম্পদের আমানত এবং তা সংরক্ষণের দায়িত্ব আরোপ হয়েছে, সে যদি ওই সম্পদের মধ্যে খেয়ানত করে, তবে তিনি (সা.) তার থেকে দায়মুক্ত।’ (বায়হাকি)।
এ রেওয়ায়েত দ্বারাও যৌথ লেনদেনের বৈধতা প্রমাণিত হয়, উপরন্তু সে ক্ষেত্রে খেয়ানত না করার নির্দেশও প্রমাণিত হয়।
হাদিস নং-৩ : নবী (সা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘যৌথ কারবারিরা যতদিন খেয়ানত না করে, ততদিন আল্লাহর হাত (সাহায্য) তাদের সঙ্গে থাকে। আর যখন তারা খেয়ানত করে বসে, তখন তাদের ব্যবসার বিলুপ্তি ঘটে এবং এর থেকে বরকত উঠিয়ে নেয়া হয়।’ (আবু দাউদ)।
এ রেওয়ায়েত দ্বারাও যৌথ ব্যবসার প্রমাণ, ফজিলত, গুরুত্ব এবং উৎসাহ পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে খেয়ানতের অশুভ পরিণতির কথাও প্রতিভাত হয়।
হাদিস নং-৪ : হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, দুইজন লোক নবী (সা.) এর যুগে যৌথ কারবার করত, তাদের একজন বাজার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত, আরেকজন মসজিদ এবং নবী (সা.) এর পেছনে নামাজ আদায়ে গুরুত্বারোপ করত। পরে যখন মুনাফা বণ্টন করার সময় হলো, তখন প্রথমজন তার অংশের চেয়ে অধিক দাবি করে বলল যে, আমাকে বেশি দিতে হবে, যেহেতু আমি ব্যবসার ক্ষেত্রে অধিক পরিশ্রম করেছি আর তুমি তো নামাজে বেশি সময় ব্যয় করেছ। অতঃপর দুইজন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করলে নবী (সা.) প্রথমজন অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত ব্যক্তিকে বললেন, তোমার এ সাথী মসজিদে পাবন্দির সঙ্গে নামাজ আদায় করার বদৌলতেই তোমাকে রিজিক দেয়া হতো।’ (আর-রাওজুন নাদির শারহু মাজমুয়িল ফিকহিল কবির ৩/৩৬২)
হাদিস নং-৫ : ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে আল্লামা শাওকানি (রহ.) আবু মিনহালের একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেনÑ
হজরত যায়দ ইবনে আরকাম এবং হজরত বারা বিন আজিব (রা.) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নগদে ও বাকিতে রুপা ক্রয় করলেন। এ কথা নবী (সা.) জানার পর বললেন, ‘যে রুপা নগদ টাকায় ক্রয় করা হয়েছে, তা ঠিক রাখ; যা বাকিতে ক্রয় করা হয়েছে, তা ফেরত দাও।’ (বোখারি)।
উল্লিখিত হাদিস থেকে তিনটি বিষয় উদ্ভাবিত হয়Ñ
১. শরিকি লেনদেনের বৈধতা। ২. দিনার-দেরহামে শরিকি লেনদেনের বৈধতা। ৩. স্বর্ণ-রুপার ক্রয়-বিক্রয় নগদে জায়েজ আর বাকিতে নাজায়েজ হওয়া।
হাদিস নং-৬ : নবী (সা.) এরশাদ করেন, “তোমরা ‘শিরকাতে মুফাওয়াজা’ (অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে শরিকি কারবার) করো। কারণ, এটি একটি অতি বরকতময় শরিকি কারবার।’ (বাদায়িউস সানায়ি)।
এ রেওয়ায়েত দ্বারাও শরিকি কারবারের বৈধতা সাধারণভাবে এবং শিরকাতে মুফাওয়াজার বৈধতা বিশেষভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। উপরন্তু এর গুরুত্ব ও ফজিলত প্রতীয়মান হচ্ছে।
হাদিস নং-৭ : নবী (সা.) এ রেওয়ায়েতের মধ্যে শরিকি কারবারের লাভ-লোকসানের মূলনীতির বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন যে, ‘মুনাফার হিসাব উভয় অংশীদারের শর্ত এবং চুক্তির ভিত্তিতে হবে। আর লোকসান উভয়ের মূলধন হিসেবে হবে।’
উপরোল্লিখিত রেওয়ায়েত দ্বারা যৌথ কারবারের শুধু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাই নয়, বরং এর লাভ-লোকসান ও বিভাজনের মূলনীতিরও প্রতিভাত হচ্ছে। অর্থাৎ মুনাফা উভয় পক্ষের চুক্তি মতে হবে আর ক্ষয়ক্ষতি উভয় পক্ষের মূলধন হিসেবে বিভাজন হবে।
হাদিস নং-৮ : নবী (সা.) এর কাজকর্ম দ্বারাও যৌথ কারবারের প্রমাণ পাওয়া যায় যে, নবী (সা.) স্বয়ং হজরত সায়িব ইবনে আবু সায়িবের (রা.) সঙ্গে ইসলামের প্রথম যুগে, আরেক রেওয়ায়েত মতে জাহিলিয়াত যুগে শরিকি কারবার করেছিলেন। আল্লামা শাওকানি (রহ.) এ সম্পর্কে কয়েকটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেনÑ
হজরত সায়িব ইবনে আবুস-সায়িব (রা.) হুজুর (সা.) কে বললেন, ‘আমি জাহিলিয়াত যুগে আপনার অংশীদার ছিলাম। আর আপনি একজন অতি সৎ অংশীদার। আপনি বেশি নম্রতা পোষণ করতেন না; আর ঝগড়ায়ও লিপ্ত হতেন না।’ (আবু দাউদ)।
আরেক রেওয়ায়েতে আছে যে, হজরত সায়িব (রা.) নবী (সা.) এর সঙ্গে ইসলামের প্রথম অবস্থায় ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। অতঃপর মক্কা বিজয় দিবসে তিনি নবী (সা.) কে বললেন, ‘ধন্যবাদ হে আমার ভাই, হে আমার অংশীদার! আপনি না বেশি নম্রতা পোষণ করতেন; আর না ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হতেন।’ (বায়হাকি)।
হাফেজ ইবনে আবদুল বার (রহ.) বলেন, তিনি নবী (সা.) এর সঙ্গে ইসলামের প্রথম যুগে ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি নবী (সা.) কে স্বাগত জানান এবং ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ হে আমার ভাই! হে আমার অংশীদার! যিনি তেমন নম্রতাও পোষণ করতেন না আবার বিবাদেও জড়িত হতেন না।’ (সুবুলুস সালাম)।
হাদিস নং-৯ : নবী (সা.) এর সাহাবি হজরত হাকিম বিন হিজাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি যখন কাউকে কোনো ঋণ দিতেন, তখন এ শর্ত আরোপ করতেন যে, ‘তুমি আমার মাল কোনো ভেজা জিনিসের মধ্যে রাখতে পারবে না, নদনদীতে নিয়ে যেতে পারবে না এবং তুমি এ মাল নিয়ে এমন কোনো স্থানে যেতে পারবে না যে স্থানে পানি প্রবাহিত হয়। যদি ওইসব কাজ তুমি করো (আর সম্পদ নষ্ট হয়) তাহলে তোমাকে এর দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে।’ (দারা কুতনি)।

Similar Articles

Advertismentspot_img

Most Popular