এবার বাংলা একডেমি পুরস্কারের প্রথম তালিকা প্রকাশে দেখা যায় কথাসাহিত্য ক্যাটাগরিতে সেলিম মোরশেদ পুরস্কৃত হয়েছেন। সেলিম মোরশেদ গতকাল রোববার ( ২৬ জানুয়ারি) রাত তিনটার সময় তার স্ত্রী কথাসাহিত্যিক ইশরাত তানিয়াকে ফোন করে জানান তিনি এ পুরস্কার প্রত্যাখান করেছেন। ইশরাত তানিয়া আজ সোমবার ( ২৭ জানুয়ারি) ভোরে এ বিষয়ে একটি পোস্টের মাধ্যমে এ কথা জানান।
পোস্টটি সেলিম মোরশেদের ভাষ্যে তুলে ধরা হয়। নিচে হুবহু পোস্টটি দেওয়া হলো :
যশোর থেকে রাত ৩টায় ফোনে কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখান
প্রিয় পাঠক ও আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা,
এই ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার, ঢাকা থেকে যশোরে চলে আসার পর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানলাম আমাকে এ বছর কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। আমি যতোটা না খুশি হয়েছি তার চেয়ে বিস্মিত হয়েছি বেশি। কারণ বাংলা একাডেমি বা এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা কেন থাকবে? তারপর দেখলাম কিছু মানুষের আনন্দ। বিশেষ করে যশোর শহরবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস। এই আনন্দ আমাকে বিপরীত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দেয়নি। পুরস্কারের বিষয়ে আমার ‘না’ বলার সুযোগও ছিলো না। কারণ পুরস্কার ঘোষণার আগে একাডেমি যোগাযোগ করেনি। আচমকাই জেনেছি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তির কথা।
এরপর দেখলাম যৌক্তিক জায়গাগুলো পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে অন্যভাবে। যেমন একবার বলা হচ্ছে—তিনি কি যোগ্য? অনেকেই বলছেন ‘যোগ্য’। দ্বিতীয়বার বলা হচ্ছে— রাজনৈতিকভাবেও তাঁর স্ট্যান্ড পয়েন্ট কী? সেক্ষেত্রেও আমি জানি, জুলাই ‘২৪ এ ফ্যাসিস্ট সরকারের গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পক্ষে আমার অবস্থান স্পষ্ট। কিন্তু তৃতীয় যে বিষয়টি এসেছে সেটা মানতে পারছি না। বিগত চৌদ্দ বছরে একজন বন্ধুর সঙ্গে শুধুমাত্র একটি দিন ফোনে কথা বলেছিলাম— সেটাও একজন কবিবন্ধু’র মেয়ের চাকরির ব্যাপারে দ্বিধাণ্বিত হয়ে। চৌদ্দ বছরে যার সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলেছি সেই বন্ধু আমার জন্য হঠাৎ করে এই লবিং করলেন এমন কথা যখন বিশ্বাসযোগ্যরূপে প্রতীয়মান হলো, আমি অবাক হলাম। ভালোও লাগলো।
এরপর যখন পুরস্কারের তালিকা স্থগিত করা হলো তখন আমার কাছে এটা আর সম্মানজনক থাকলো না। না, ছোটোকাগজ আন্দোলন কিংবা প্রতিষ্ঠান-অপ্রতিষ্ঠানের জন্য না। এর কারণ, আমি দেখে ফেললাম কিছু অ-লেখক এবং লোভী-লেখকের ইন্ধন এবং তৎপরতা। যারা আমার সম্মান নিয়ে খেলা করার ক্ষমতা রাখে না। জীবিত লেখকদের মধ্যে আমি বোধ হয় সেই লেখক যে নিজের বিচার-বুদ্ধি অনুসারে চলি। আমি বাংলা একাডেমির এই পুরস্কার বিনীতভাবে প্রত্যাখান করছি।
আমাকে যে আগে থেকে না জানিয়ে এই পুরস্কার দেয়া হলো, আমি সেই লবিস্টদের প্রশংসা করছি। আগে জানালে হয়তো আমি পুরস্কারটি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতাম। কোনো রাজনৈতিক চাপ কিংবা পাঠক-সন্তুষ্টির জায়গা থেকে এখন এই পুরস্কার থেকে সরে আসছি না। প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে আমার নিজের জন্য। আমার পক্ষে লবিংয়ের জন্য যাঁদের দায়ী করা হচ্ছে এবং বাংলা একাডেমির ডিজি মহোদয় মোহাম্মদ আজমকে অসম্মান করা হচ্ছে— আমি তাঁদের হারানো সম্মান কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এই কারনে যে, তাঁদের সাংস্কৃতিক উচ্চতার প্রমাণ এরই মধ্যে তাঁরা আমার কাছে দিয়েছেন। ফলে আমার এই প্রত্যাখান তাঁদের পক্ষেই যাবে। তাঁরা জানেন আমি কখনোই মিডিয়ার খোরাক দেয়ার মতো লিখি না, লিখবোও না। তারপরও যে ঝুঁকিটা তাঁরা নিলেন সেটা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অন্যান্য কারণ যতোই উত্থাপিত হোক না কেন, এটা তো সত্য, আমাকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করার কারণে তাঁদের ছোটো হতে হয়েছে, ছোটোদের কাছে। সেটা আমি চাই না।
যাদের হাতে এখনো লেখা আসেনি তাদের আলটিমেটামের ওপর অন্তত আমার সাহিত্য দাঁড়িয়ে নেই। বাংলা একাডেমির এই বিব্রতকর পরিস্থিতি উদ্ভবের কারণ— প্রস্তাবক বা নির্বাচক মণ্ডলী তাঁদের সাহিত্যরুচির শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। তাঁদের এই প্রয়াস তারিফযোগ্য।
এ কথাও সত্য যে, ছাত্র-সমন্বয়কদের কথা ভেবে আমি বার বার সম্মত হতে চেয়েছি— হয়েও ছিলাম কিন্তু বিষয়টা সেদিকে গেলো না। নানান রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির কর্মীদের অভিলাষটুকু দেখে চিন্তিত হলাম। এমনটা তো চাইনি!
আমি ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’ প্রত্যাখ্যান করলাম। অন্যরা নিশ্চয়ই কথাসাহিত্যে আমার চেয়ে গুণী লেখক খুঁজে পাবেন।
যারা আমার সত্যিকারের পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের জন্য ভালোবাসা।
জুলাই ‘২৪ এর গণঅভ্যুত্থান দীর্ঘজীবী হোক।
সেলিম মোরশেদ
কথাসাহিত্যিক।