নিউজ ডেস্ক:
স্ট্যানলি কুবরিক মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক। এই পরিচয়ই শেষ নয়, কুবরিক একাধারে চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক ও আলোকচিত্রী।
স্ট্যানলি কুবরিক ১৯২৮ সালের ২৬ জুলাই ম্যানহাটনের লাইং-ইন হসপিটালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জ্যাক লিওনার্ড কুবরিক ও মায়ের নাম জারট্রুডে।
১২ বছর বয়সে বাবার কাছে কুবরিক দাবা খেলা শেখেন। দাবার প্রতি তার অন্যরকম অনুরাগ ছিল। দাবার পর ছবি তোলা ছিল তার পছন্দের কাজ। ১৩ বছর বয়সে বাবার কাছ থেকে একটি গ্র্যাফলেক্স ক্যামেরা পেয়েছিলেন তিনি। তা দিয়েই ছবি তুলতেন। এ ছাড়া কৈশোরে জ্যাজ সঙ্গীতের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন কুবরিক। পরবর্তীতে ড্রামার হিসেবে একটি ব্যান্ড দলে যোগ দেন। অবশ্য বেশি দিন থাকেননি ব্যান্ডে।
পড়াশোনায় খুব বেশি ভাল ছিলেন না স্ট্যানলি কুবরিক। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত কুবরিক উইলিয়াম হাওয়ার্প ট্যাফ্ট স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি স্কুলে ১০০ নম্বরের মধ্যে কখনো ৬৭ এর উপরে পাননি।
১৯৪৫ সালে হাই স্কুল পাস করার পর উচ্চ শিক্ষা নিতে চেয়েছিলেন কুবরিক।কিন্তু একে তো তার রেজাল্ট খারাপ, তার ওপর তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা অসংখ্য স্কুলপাস ছাত্রের চাপ। সব মিলিয়ে তাই আর উচ্চ শিক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি তখন। পরে কুবরিক স্কুলে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়ে। স্কুলের কোনোকিছুই তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। এক সময় স্কুলশিক্ষার সমালোচনা করেছেন তিনি। উচ্চশিক্ষা সম্ভব না হওয়ায় তার বাবা তাকে এক বছরের জন্য লস এঞ্জেলেসে পাঠান এক আত্মীয়ের বাসায়।ভেবেছিলেন দূরে গেলে ছেলের মধ্যে কিছুটা দায়িত্বজ্ঞান তৈরি হবে। স্কুলে থাকতে অবশ্য তার ছবি তোলার শখটা প্রশংসা পেয়েছিল। তিনি স্কুলের অফিসিয়াল আলোকচিত্রীর সম্মানও পেয়েছিলেন।
১৯৪৬ সালে কুবরিক কিছুদিনের জন্য সিটি কলেজ অফ নিউ ইয়র্ক-এ পড়াশোনা করেন। সেখানেও তার মন বসেনি। শেষে ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার আগেই তার বেশ কিছু ছবি লুক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে আবার ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্ক ও ম্যানহাটনের দাবা ক্লাবগুলোতে দাবা খেলেও কিছু অর্থ উপার্জন করেছেন।
১৯৪৬ সালেই লুক ম্যাগাজিনের নবিস আলোকচিত্রীর চাকরি পান। কিছুদিন পর তার চাকরি স্থায়ী হয়। সে সময়ে (১৯৪৫-৫০) কুবরিকের তোলা অনেকগুলো ছবি ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘ড্রামা অ্যান্ড শ্যাডোস’বইয়ে স্থান পেয়েছে। আর ২০০৭ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত সিনেমা ২০০১ : আ স্পেস অডিসির বিশেষ ডিভিডি সংস্করণেও কিছু ছবি স্থান পেয়েছে। সব মিলিয়ে তিনি লুক ম্যাগাজিনের জন্য প্রায় ৫-৬ হাজার ছবি তোলেন।
১৯৪৮ সালের ২৯শে মে স্ট্যানলি কুবরিক টোবা মেৎসকে বিয়ে করেন। ১৯৫১ সালে অবশ্য তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।এই সময় থেকেই প্রচুর সিনেমা দেখা শুরু করেন কুবরিক। মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট এর চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে নিয়মিত যেতেন। এ ছাড়া নিউ ইয়র্ক সিটিতে মুক্তি পাওয়া কোনো সিনেমাই বাদ যেতো না।
স্ট্যানলি কুবরিকের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৫০ সালে। আরকেও-র জন্য দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র বানানোর মধ্য দিয়ে তার যাত্রা। এরপর তিনি বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দুটি নিম্ন বাজেটের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানান। প্রকৃতপক্ষে এই সিনেমাগুলো তাকে চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রস্তুত করতে সাহায্য করে। যদিও একসময় তিনি এই সিনেমাগুলোর কথা ভুলে যেতে চাইতেন। সিনেমা দুটির কারিগরি সব কাজ তিনি নিজেই করেছেন। পরিচালনা থেকে শুরু করে চিত্রগ্রহণ, শব্দ ধারণ ও সংযোগ, সম্পাদনা সবকিছু।
১৯৫৫ সালে তিনি উঠতি প্রযোজক জেমস হ্যারিসের সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময় দুজনে মিলে একটি পুঁচকে গুণ্ডা দলের ঘোড়দৌঁড়ের টাকা ডাকাতির কাহিনী নিয়ে দ্য কিলিং সিনেমাটি বানান। এই সিনেমা ব্যবসায়িকভাবে বেশ সফল হয়। এই সিনেমা দিয়ে কুবরিক বেশ পরিচিতিও পান।
এরপর কুবরিক হামফ্রি কব এর উপন্যাস দ্য পাথস অফ গ্লোরি-র স্বত্ব কিনেন। আর ১৯৫৭ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে এমন এক সিনেমা নির্মাণ করেন, যা ইতিহাসের সবচেয়ে আপোষহীন যুদ্ধবিরোধী সিনেমাগুলোর একটিতে রূপান্তরিত হয়।
এরপর তিনি খ্রিস্টপূর্ব যুগের রোমান সম্রাজ্যে দাস বিদ্রোহ নিয়ে ‘স্পার্টাকাস’ সিনেমাটি বানান। তবে এই সিনেমার পরিচালনায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি তিনি। কারণ সিনেমাটিতে তার পাশাপাশি কার্ক ডগলাসও প্রযোজক ছিলেন। ‘স্পার্টাকাস’ ভালো হয়েছিল যদিও, তথাপি স্ট্যানলি কুবরিক শপথ নিলেন পূর্ণ শৈল্পিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ছাড়া জীবনে আর কোনো সিনেমা বানাবেন না।
কুবরিকই একমাত্র পরিচালক যিনি হলিউডের স্টুডিওতন্ত্রের মধ্যে থেকেও সবচেয়ে স্বাধীনভাবে সৃষ্টিশীল কাজ করার চেষ্টা করেছেন। এর মাধ্যমেই তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকারদের সারিতে নিয়ে যান। প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিলেন বলেই এক সময় তিনি তার সব সিনেমার ওপর পূর্ণ শৈল্পিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।
কুবরিকের বিখ্যাত ছবি ‘২০০১: আ স্পেস অডিসি’। মানুষের তৈরি মারণাস্ত্র মানুষ খুনে ব্যবহার, আর যান্ত্রিক যুগে মানুষের নৈরাশ্যজনক বৈশিষ্ট্যতার পরিণতি নিয়ে এই ছবি বানান। স্পেস অডিসিতে তিনি হ্যাল নামক কম্পিউটারকে মানুষের ভঙ্গিতে কথা বলিয়ে যন্ত্রের মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে তা মানুষের নৈরাশ্যেরও কারণ ছিল। মানুষ, জীবন, যান্ত্রিকতা নিয়ে স্পেস অডিসি দর্শকদের এক দ্বান্দ্বিকতায় যেন ফেললো, সেখান থেকে কুবরিকই টেনে তুললেন দর্শকদের পরবর্তী সিনেমা ‘ক্লকওয়ার্ক’ দিয়ে। যদিও এই সিনেমায়ও নৈরাশ্যবাদী ব্যাপার ছিল। তারপরও এই সিনেমায় তিনি বলতে চেয়েছেন বিশ্বে টিকে থাকতে হলে মানুষকে তার মানবিকতা ধরে রাখতেই হবে। মানুষকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, নিজের বানানো যন্ত্রের ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইলে মানুষকে আগে নিজের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনটি সিনেমা বানান তিনি। কুবরিক ‘দ্য শাইনিং’ নামে একটি হরর সিনেমাও বানিয়েছেন।
তিনি মোট ১৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছে তার সিনেমাগুলো বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। ভিন্ন বিষয় ও ভিন্ন আঙ্গিকে বানানো সিনেমাগুলোর প্রত্যেকটি এক একটি মাস্টারপিস।
কুবরিক নির্মিত প্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- ডে অব দ্য ফাইট (১৯৫১), ফ্লাইং পাদ্রে (১৯৫১) ও দ্য সিফেয়ারার্স (১৯৫৩)। পূ্র্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- ফিয়ার অ্যান্ড ডিজায়ার (১৯৫৩), কিলারস কিস (১৯৫৫), দ্য কিলিং (১৯৫৬), প্যাথস অব গ্লোরি (১৯৫৭), স্পার্টাকাস (১৯৬০), লোলিটা (১৯৬২), ড. স্ট্রেঞ্জলাভ অর : হাউ আই লার্নড টু স্টপ ওরিয়িং অ্যান্ড লাভ দ্য বম (১৯৬৪), ২০০১ : আ স্পেস অডিসি (১৯৬৮), আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ (১৯৭১), ব্যারি লিন্ডন (১৯৭৫), দ্য শাইনিং (১৯৮০), ফুল মেটাল জ্যাকেট (১৯৮৭) ও আইস ওয়াইড শাট (১৯৯৯)।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে কুবরিক অনেক সম্মানজনক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৬৮ সালে স্পেস অডিসিতে বেস্ট ভিজুয়াল এফেক্টসের জন্য তিনি অস্কার পান। পরিচালক হিসেবে পাননি। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৭ সালে ‘দ্য ডিরেক্টরস গিল্ড অব আমেরিকা’র সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘ডিডব্লিউ গ্রিফিথ অ্যাওয়ার্ড’ পান। একই বছর অনুষ্ঠিত ৫৪তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন লায়ন অ্যাওয়ার্ড’পান।
স্ট্যানলি কুবরিক ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে কুবরিক প্রভাব বিস্তারকারী এক পরিচালক। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দিতে সবচেয়ে প্রভাশালী পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। তাকে চলচ্চিত্র ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা সৃজনশীল নির্মাতা হিসেবেও গণ্য করা হয়। কুবরিকই বোধহয় একমাত্র পরিচালক, যিনি বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যকর্মকে সবচেয়ে সফলভাবে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন। কারিগরি দিক থেকেও তার সিনেমা ছিল অনন্য। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তিনি অনেক কারিগরি কৌশল উদ্ভাবন করেছেন।