নিউজ ডেস্ক:
আমানতকারীদের গোপনীয়তা রক্ষায় সুইজারল্যান্ডের সাংবিধানিক আইনের দ্বারা অঙ্গীকারবদ্ধ দেশটির বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো (সুইস ব্যাংক)। আমানতকারীদের নাম, ঠিকানা, জমা অর্থের পরিমাণ অত্যন্ত গোপনে সুরক্ষিত রাখে বলে বিশ্বব্যাপী সুইস ব্যাংকের এত সুনাম। বিশ্বের কালো টাকার মালিকরা তাদের সম্পদ গচ্ছিত রাখতে বেছে নেয় ব্যাংকগুলোকে। এ নিয়ে সুইস ব্যাংকের দুর্নামও রয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন দেশের সমালোচনার মুখে অবশ্য পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। আমানতকারীদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে দেশটি। বিশেষ করে তাদের ব্যাংকে কোনো আমানতকারীর রাখা অর্থে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে ওই ব্যক্তির সমুদয় তথ্য দেওয়ার আইন শিথিল করছে। আরও কিছু বিষয়ও শিথিল করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর আওতায় ইতোমধ্যে সুইস ব্যাংক থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে আমেরিকা ও কানাডা। এই দুটি দেশের যেসব নাগরিক নিজেদের সম্পদের তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিয়েছেন তাদের তালিকা সংগ্রহ করে বকেয়া কর আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ভারত থেকে যারা সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার করেছে তাদের তালিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। ইতোমধ্যে তারা সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ভারত থেকে যারা সুইস ব্যাংকে অর্থ পাঠিয়েছেন তাদের তালিকাও পেয়ে যাবে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকও চেষ্টা করছে সুইস ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশি আমানতকারীদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে আবার সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেবে। অচিরেই এই চিঠি পাঠানো হবে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক করার বিষয়ে আবারও উদ্যোগ নেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, নতুন উদ্যোগের ফলে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এবার হয়তো তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। যদিও এর আগে কয়েক দফায় চিঠি দিয়েও সুইস ব্যাংক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান আমাদের সময়কে বলেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে সরকার উদ্যোগী। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। গত বুধবার সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ডের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় (সুইস ব্যাংক) গোপনে সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে অন্য দেশের ধনাঢ্য নাগরিকদের আস্থা কমলেও বেড়েছে বাংলাদেশিদের। ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা (মুদ্রার দাম ওঠানামার কারণে টাকার অঙ্কে কমবেশি হয়)। ওই হিসাবে এক বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে ১৯ শতাংশ বেড়েছে। গত ২০১১ সাল থেকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এর আগে কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। সুইস ব্যাংকে টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। যে কারণে ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশিদের জমা টাকার ব্যাপারে জানতে চেয়ে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু ওই চিঠির কোনো জবাব দেয়নি। ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক করার উদ্যোগ নিয়ে চিঠি দিয়েছিল। এরও কোনো জবাব দেয়নি তারা। ২০১৫ সালে একই প্রতিবেদনে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমার পরিমাণ বাড়ার তথ্য প্রকাশিত হলে আবার বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে চিঠি দেয়। এই চিঠিরও জবাব দেয়নি তারা। এ বিষয়ে কোনো সাড়া না পাওয়ায় গত বছর কোনো চিঠি দেয়নি। এবার আবার চিঠি ০ হচ্ছে। এর আগে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক কনসোর্টিয়াম (আইসিআইজে) হংকংয়ে নিবন্ধিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার করা টাকার একটি তালিকা প্রকাশ করে। ২০৩টি দেশের গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশভিত্তিক ওই তালিকা প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৮ নম্বরে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ১৭টি হিসাবের মাধ্যমে ১৬ জন গ্রাহক ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার করেছে। ওইসব অর্থ বাংলাদেশের এইচএসবিসির শাখা থেকে সুইজারল্যান্ডের শাখায় বেআইনিভাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে গ্রাহকদের ১০টি ব্যক্তিগত এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ৭টি হিসাব। ব্যক্তিগত ১০টি হিসাবের মধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী রয়েছেন ৫ জন। তবে তাদের পরিচয় সম্পর্কে সংস্থাটি কিছুই প্রকাশ করেনি। এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অবশ্য বাংলাদেশের মুসা বিন শমসেরের বিষয়ে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তথ্য চাইলে সাড়া দেয়। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানায়, ওই নামে তাদের দেশের ব্যাংকগুলোয় কোনো হিসাব নেই। পরে তার নিজের কয়েক ধরনের নাম ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নাম সংগ্রহ করে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।