সাবেক ৫০ নারী এমপি করজালে

0
7

এমপি হতে পারলেই টাকা আর টাকা! তাই এমপির মনোনয়ন ‘কিনতে’ বিপুল টাকার ছড়াছড়ি হয়। কোনোমতে এমপির মনোনয়ন পেয়ে গেলেই সরাসরি সংসদ সদস্য। তখন এমপি হওয়ার ‘খরচের’ টাকা ওঠাতে আর সময় লাগবে না। এমপি হওয়ার পেছনে টাকা খরচের এমন বদ্ধমূল ধারণা সব স্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যেই।

আওয়ামী লীগের গত শাসনামলে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে এই সন্দেহ আরও প্রকট হয়েছিল। কারণ ওই সময়ে রাজনীতিতে বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা না থাকলেও অনেকেই এমপি হতে পেরেছিলেন। সাধারণ মানুষের মতো এমপি পদ ‘কিনতে’ টাকা খরচের সন্দেহ এখন খোদ কর বিভাগের। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর গোয়েন্দা বিভাগ এখন অবৈধ টাকায় এমপি হওয়ার সন্দেহে ওই ৫০ সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিকে খুঁজছে।

তাঁদের নাম ধরে, টিম বানিয়ে তাঁদের সব বৈধ-অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে। তাঁদের আয়-ব্যয়, জীবনযাপন, সম্পদের যাবতীয় তথ্য খুঁজে বের করবেন কর গোয়েন্দারা। অবৈধ সম্পদ বা কালো টাকার সন্ধান পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে ‘বিনা ভোট’, ‘রাতের ভোট’ ও ‘ডামি ভোট’ হওয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। ওই সব নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসন পেতেও কালো টাকার ছড়াছড়ি ছিল বলে সবার ধারণা। প্রচার রয়েছে কোনো কোনো সংরক্ষিত আসনের এমপি পদের দর শতকোটি টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এত টাকায় এমপি হয়ে থাকলে ওই এমপিরা সত্যিকার অর্থে কত টাকার মালিক? আর ওই টাকা তাঁরা কিভাবে আয় করেছিলেন? তাঁদের বৈধ আয়ের উৎস কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে সন্দেহভাজন মহিলা এমপিদের ধরতে তাই ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বেছে নিয়েছেন কর গোয়েন্দারা।

এরই মধ্যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসন বাগিয়ে নেওয়া ৫০ জনের আয়কর নথি যাচাই শুরু হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, “সংরক্ষিত নারী আসনে কোনো নির্বাচন হয় না। দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে তাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই পদ নিতে কোটি কোটি টাকা দিয়ে দলকে ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছিল। যাঁরা এই পদে ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁদের এই সক্ষমতা আছে কি না, তা যাচাই করে দেখা হবে।”

তিনি আরো বলেন, ‘নারী এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে যে টাকা তাঁরা খরচ করেছেন, আয়কর নথি অনুযায়ী সেই সক্ষমতা দেখাতে না পারলে বা সম্পদ গোপন বা অন্য কোনো ধরনের অসংগতি পাওয়া গেলে আয়কর আইন অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টাকার উৎস নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলে সে বিষয়ে দুদক তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’

করজালে সংরক্ষিত আসনের সেই ৫০ এমপি : জানা যায়, সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর বিপরীতে হেরে যান সানজিদা খানম ও মেহের আফরোজ চুমকি। দুজনই আগে এমপি ছিলেন। দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে প্রার্থিতা বাতিল হয়েছিল আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদের। মনোনয়ন চেয়েও পাননি সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা। তাঁরা প্রত্যেকেই পরবর্তী সময়ে পেয়েছেন সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন।

সংরক্ষিত আসনে এমপি হয়ে পরে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন ওয়াসিকা আয়শা খান। এনবিআরের সাবেক আয়কর নীতির সদস্য মো. আলমগীর হোসেনের স্ত্রী নাদিয়া বিনতে আমিনও পেয়েছিলেন সংসদের টিকিট। আগেও সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন ফরিদুন্নাহার লাইলী ও নাজমা আকতার। তাঁরাও ছিলেন এমপি হওয়ার তালিকায়। পিছিয়ে ছিলেন না জাতীয় প্রেস ক্লাবের দুইবারের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিনও।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করলেও রাজাকারের মেয়ে বলে পরিচিত রেজিয়া ইসলামকে সংরক্ষিত আসনের এমপি বানিয়ে বসানো হয়েছিল সংসদে। এ ছাড়া পারভীন জামান কল্পনা, শামসুন নাহার চাঁপা, রোকেয়া সুলতানা, দ্রৌপদী দেবী আগরওয়াল, আশিকা সুলতানা, কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি, জারা জেবিন মাহবুব, ফরিদা আক্তার বানু, ফারজানা সুমি, খালেদা বাহার বিউটি, উম্মে ফারজানা সাত্তার, মাহফুজা সুলতানা মলি, আরমা দত্ত, লায়লা পারভীন, বেদৌরা আহমেদ সালাম, শবনম জাহান, পারুল আক্তার, সাবেরা বেগম, নাহিদ ইজহার খান, ঝর্ণা আহসান, শাহিদা তারেখ দীপ্তি, অনিমা মুক্তি গোমেজ, শেখ আনার কলি পুতুল, মাসুদা সিদ্দীক রোজী, তারানা হালিম, অপরাজিতা হক, হাসিনা বারী চৌধুরী, আশরাফুন নেছা, কানন আরা বেগম, শামীমা হারুন লুবনা, ফরিদা খানম, দিলারা ইউসুফ, জ্বরতী তঞ্চঙ্গ্যা, নাছিমা জামান ববি, নাজনীন নাহার রোশা ও রুমা চক্রবর্তী সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের ব্যানারে এমপি হয়েছিলেন।

নির্বাচনে টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা প্রসঙ্গে সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি অর্থ প্রতিমন্ত্রীসহ অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। নেত্রকোনা থেকে মনোনীত সংরক্ষিত আসনের এমপি নাদিয়া বিনতে আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্যদের ব্যাপারে আমি ঠিক জানি না। আমি এক টাকাও ডোনেশন দিইনি। আমি নিজের এলাকায় কাজ করতে চেয়েছিলাম। প্রথমে নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে পাইনি। আহমেদ হোসেন সে সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে আমি সংরক্ষিত আসনের জন্য চেয়েছি এবং দল আমাকে দিয়েছে।’

তবে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন বিক্রির অভিযোগকে মনগড়া ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন। দক্ষতা, যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে দল থেকে তাঁদের মনোনীত করা হয়েছে। এর সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। যাঁরা এমন মিথ্যা অভিযোগ করছেন, আওয়ামী লীগের বদনাম করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।’

যদিও ভিন্নমত পোষণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর যারা তাদের সবাই দুর্নীতি-অনাচারের সঙ্গে যুক্ত। ফ্যাসিবাদী সরকার দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে ফেলেছিল। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’

টাকা দিয়ে ‘সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন ক্রয়’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা এনবিআরের খুঁজে দেখা উচিত। সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়েছে।’

জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন দুজন এমপি। তাঁরা হলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুন নাহার। জানা গেছে, নির্বাচনের পর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরের নাম আলোচনায় থাকলেও বেশি টাকায় অন্য প্রার্থীকে ছেড়ে দেওয়ায় তিনি মনোনয়ন পাননি।

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থাকায় মনোনয়ন পাওয়াটাই ছিল বড় বিষয়। কেউ মনোনয়ন কিনতে পারলেই এমপি হয়ে যাওয়া অনেকটা সময়ের ব্যাপার ছিল। তাই সবাই ছুটেছে মনোনয়ন ‘কেনা’র দৌড়ে। টাকা খরচে যে বেশি উদার ছিল, তাঁর মনোনয়নই নিশ্চিত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। টাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য, রাজনীতিতে পরীক্ষিত কর্মীরও মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমপি হতে পারলেই এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা কামানো সহজ। এই আশায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা টাকা খরচে কার্পণ্য করেননি।

সর্বশেষ ২০২৪ সালে প্রতিপক্ষবিহীন ডামি ভোটের নির্বাচনের পর ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের এমপির মধ্যে ‘আমি’ ও ‘ডামি’ প্রার্থীদের সমর্থনে ৪৮টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বাকি দুটি আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল জাতীয় পার্টি।

জানা গেছে, শুধু আওয়ামী লীগের ৪৮টি সংরক্ষিত নারী আসনের বিপরীতে ফরম জমা দিয়েছিলেন এক হাজার ৫৪৯ জন। এই বিশাল সংখ্যা থেকে সীমিত সংখ্যা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তেলবাজি, তোষামোদ, দলদাসত্ব ও ক্ষমতার তাঁবেদারির পাশাপাশি বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে বিপুল টাকা। চূড়ান্ত মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের প্রতি ত্যাগ আমলে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন অনেকেই।