নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি : স্ত্রীকে দুঃসহ নির্যাতনের পর তারই করা মামলায় আদালতের নির্দেশে স্বামী নুরে আলম যখন কারাগারে, তখন পারিবারিক ও সামাজিকতার বাইরেও আইনের বেরাজ্বাল ছিন্ন করে হলেও একমাত্র সন্তানকে নিজের বুকে ফিরে পেতে চান সৈয়দা হামিদা হাসান পলি নামে এক মা। সোমবার নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্ট এলাকায় এ প্রতিবদকের সাথে আলাপকালে চোখের জলে এমনি আহাজারি করেন পলি।
পলি এ প্রতিবেদককে বলেন- আমার স্বামী আমারই করা নারী-শিশু ও যৌতুক মামলায় বর্তমানে কারাগারে। অথচ আমার একমাত্র শিশু সন্তান(১৩) পিয়াস এখন আপন বাবা-মা’কে ছাড়া সৎ মায়ের (আমার অনুমতি ব্যতিত বিয়ে করা স্ত্রী)কাছে অবহেলা-অনাদরে দিন কাটাচ্ছে। ছেলটার লেখাপড়া নষ্ট হচ্ছে। ছেলেটা আমার হাত ছাড়া কখনো খেতেই পারেনা। ও কি খাচ্ছে, কি করছে আমাকে এর কিছুই জানতে দেয়া হচ্ছেনা। বেশ কয়েকবার ছেলের সাথে দেখা করতে চেয়েও ওদের বাধার মুখে তা পারিনি। অথচ আজ ওরা ষড়যন্ত্র করে আমারই একমাত্র সন্তানকে আমারই বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী দেয়ার জন্য শিখিয়ে নিয়ে এসেছিল।
জানা গেছে, ২০০১ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাকরিরত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাসান আলীর মেয়ে সৈয়দা হামিদা হাসান পলি (৩১) কে ভালবেসে বিয়ে করে নরসিংদীর শিবপুরের যশর উত্তরপাড়া এলাকার মৃত. আহাম্মদ আলীর ছেলে নুরে আলম (৩৯)। এরই মধ্যে তাদের সংসারে আসে নুরে হানজালা পিয়াস (১৩) নামে এক পুত্র সন্তান। ওই সময় স্বামী নূরে আলম ছিলেন ২২শ’ টাকা মুজুরীর একজন নৈশ প্রহরী। টানাটানির সংসার প্রায়ই ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকত। বিয়ের পর থেকে মাদকাসক্ত স্বামী নূরে আলম যৌতুকের জন্য বিভিন্ন সময় স্ত্রী পলির উপর চালাত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। পারিবারিক সুখের কথা চিন্তা করে স্ত্রী পলি তার পরিবার থেকে কয়েক দফায় প্রায় দেড় লাখ টাকা এনে দেয়। কিন্তু দিন দিন যৌতুকের চাহিদা বাড়তে থাকে তার। পরবর্তিতে স্ত্রী পলির বাবা চাকরী থেকে অবসর নেয়ার পর পেনসন বাবদ পাওয়া কয়েক লাখ টাকা দিয়ে শশুর মুক্তিযোদা আব্দুল হামিদ তার মেয়ের জামাইর জন্য বন্দরের হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা কর্মীর চাকরি ব্যবস্থা করে দেন। স্বামী নূরে আলমের প্রতিদিন মাদক সেবন ও একের পর এক নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনা এলাকার কাউন্সিলর থেকে শুরু করে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানানোর কারনে সে আরো মারমুখী হয়ে ওঠে। এর ফলে স্ত্রী পলিকে কয়েকবার মারাত্মক শারীরিক নির্যাতন করার ফলে সে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়। এসব ঘটনা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে জানানোর পর বিচার শালিসের পর পাষন্ড স্বামী নুরে আলমকে কয়েক দফা হুশিয়ারও করা হয় বলে অভিযোগে প্রকাশ।
পলির ভাষায়- আমি ও আমার বাবা খুব চেষ্টা করে ভাল টাকা বেতনের চাকরিটা নিয়ে দেয়ার পর থেকে গত ৪ বছরে আলম আমাকে যত ধরনের নির্যাতন করে যাচ্ছিল তার সবই সয়ে যাচ্ছিলাম শুধু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। কখনো কম বয়সী নারীদের সাথে আমার সৌন্দয্যের তুলনা করে আমাকে বয়স্কা বলা, কখনো মারধর সহ আমার গায়ে থুথু ছেটানো কিংবা সরাসরি আমার গায়ে প্র¯্রাব করে দেয়া, অন্য নারীর সাথে ওকে অপ্রস্তুত অবস্থায় এলাকাবাসী হাতেনাতে ধরাসহ ওর সম¯Í অন্যায় অত্যাচার সয়েও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পুনরায় ৫ লাখ টাকা যৌতুকের দাবীতে উৎপীড়ন বাড়িয়ে দেয়ার এক পর্যায়ে গত বছরের ৪ আগস্ট আমার এক নারী সহকর্মী ও ঢাকার ডেমরা থানার এসআই আলমগীর মজুমদারকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ঘৃন্য নাটক সাজিয়ে আমার সহকর্মী বাদলকে জড়িয়ে আমাকে যৌনকর্মী আখ্যা দিয়ে আটক করে থানায় নিয়ে যায় আমার পাষন্ড স্বামী আলম। থানায় নেয়ার পর আমার বড় বোনের কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন এসআই আলমগীর মজুমদার। তাৎÿনিক এতগুলো টাকা আমার বোন ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি বলে আমাকে যৌনকর্মী বানিয়ে আদালতে চালান দেন এসআই আলমগীর। আদালত থেকে জামিনে বেড়িয়ে বাবার বাসায় ফিরে জানতে পারি আমার স্বামী আলম নরসিংদীর এক মেয়েকে বিয়ে করে আমাদের ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেছে।
গৃহবধূ পলির দাবি, আমি সেদিন সেখানে পৌছানোর আগে থেকেই নুরে আলমের সাথে ডেমরা থানার এসআই আলমগীর মজুমদার ও আমার সহকর্মী মনিসহ অন্য সহযোগিদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হচ্ছিল। শুধু তাই নয়, এই ঘটনার আগে ও পরের ২ মাসের কললিস্টে স্পষ্টভাবে প্রমান মিলেছে যে অভিযুক্তদের সাথে সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করেই এ ঘটনার নাটক সাজানো হয়েছে।
ওই ঘটনার পর গত ১৭ অক্টোবর সকল তথ্য ও প্রমান সংগ্রহ করে নির্যাতিতা গৃহবধূ সৈয়দা হামিদা হাসান পলি ও তার পরিবার আদালতের দারস্থ হয়ে পাষন্ড নূরে আলমের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং ৩০৮/২০১৭) আদালত ঘটনাটি আমলে নিয়ে আসামী নূরে আলমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গত ২৫ জানুয়ারি রাতে বন্দর থানা পুলিশ হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র আবাসিক এলাকা থেকে অভিযুক্ত নূরে আলমকে গ্রেপ্তার করে। পরে শুক্রবার দুপুরে তাকে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠায়।
অপরদিকে, আসামী নূরে আলমকে জামিনে মুক্ত করতে গৃহবধূ সৈয়দা হামিদা হাসান পলি উপর বিভিন্ন প্রভাবশালীর মাধ্যমে হুমকী ধামকী দিয়ে আসছে হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সিকিউরিটি সুপারভাইজার আতিকুর রহমান। পাষন্ড নুরে আলমকে জেলহাজতে বন্দি থেকে আতিকুর রহমান সহ বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে পলি ও তার পরিবারকে হুমকি ধামকী দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ করেন পলি ও তার পরিবার।
এ অবস্থায় নির্যাতিত গৃহবধূ পলির দাবি, স্বামী নুরে আলমের যথাযোগ্য শাস্তি দেয়া হোক্, যেনো আর কোনো স্ত্রীকে তার স্বামীর দ্বারা এই ধরনের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে সমাজে মাথা নিচু করে বাঁচতে না হয়। এছাড়াও তিনি তার একমাত্র সন্তানকে ফিরে পেতে সকলের সহযোগিতা চান।
প্রসঙ্গত, সোমবার ৫ ফেব্রুয়ারি পূণরায় আসামীর পক্ষে তার আইনজীবী জামিন আবেদন করলে মাননীয় আদালত তা না মঞ্জুর করেন।