শিশুর মনোজগৎ যেন আরো বেশি সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে শিশুসাহিত্য রচনায় শিশুসাহিত্যিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। তিনি বলেন, শিশুর ভবিষ্যৎ নির্মাণে শিশুসাহিত্যিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুর শিশুমনস্তত্ব বুঝে শিশুদের জন্য শিশুসাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিশুদের আনন্দকে ধারণ করে শিশুদের জন্য ভালো বই রচনা ও প্রকাশ করা জরুরি।
তিনি গতকাল শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি আয়োজিত দুইদিন ব্যাপী ‘শিশুসাহিত্য উৎসব ২০২৪’ এর উদ্বোধক হিসেবে রাখা বক্তব্যে এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উৎসবের প্রথম অধিবেশনে সূচনা বক্তব্য দেন একাডেমির পরিচালক কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ। সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক এলিজাবেথ আরিফা মুবাশ্শিরা। সঞ্চালনা করেন বাচিকশিল্পী আয়েশা হক শিমু। আলোচনা সভার পূর্বে বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক।
তিনি শিশুদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তবে তোমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই বর্তমান জানি, ভবিষ্যৎ জানি না। বর্তমানের উপর ভর করে যদি এগিয়ে যেতে না পার তাহলে তোমাদের ভবিষ্যৎ ভাল হবে না। তিনি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্ন দেখে তা পূরণে লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। এসময় এ পি জে আবুল কালামের ‘স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে’ উদ্ধৃত করে বলেন, স্বপ্ন দেখতে হবে জেগে জেগে। কারণ ঘুমের মধ্যে আমরা যে স্বপ্ন দেখি সেটা অলীক, বাস্তব না। কিন্তু জেগে থেকে যে স্বপ্নটা দেখব সেটাই আসল স্বপ্ন। জেগে দেখা স্বপ্নের মধ্যে নিহিত থাকবে আমরা কী হতে চাই, নিজেকে কত উচ্চতায় নিয়ে যাব। একইসঙ্গে নিজেকে উন্নতির চূড়ায় নিয়ে যেতে বর্তমানকে কাজে লাগতে হবে। এতে ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল হবে।
এম এ মালেক মা–বাবা ও শিক্ষকের গুরুত্ব ও মর্যাদা তুলে ধরে বলেন, এই পৃথিবীতে মাত্র তিনজন মানুষ আছেন যারা তোমার থেকে কোনো কিছু আশা না করে তোমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তারা হলেন, মা–বাবা এবং তোমার শিক্ষক। মা–বাবা, শিক্ষক কোনো বিনিময় ছাড়া একজন শিশুকে ভালোবাসে তার ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, তুমি চাকরি বা ব্যবসা ক্ষেত্রে সফল হয়ে তোমার শিক্ষককে দেখে যদি সালাম কর তখন শিক্ষক তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। তুমি যেন আরো সফল হও তার জন্য দোয়া করবে। তাই মা–বাবা আর শিক্ষকদের উপদেশ মান্য করে চলতে হবে। কেননা তারাই এই পৃথিবীতে তোমাদের ভালো চায়।
তিনি বলেন, মানুষ মরণশীল। সবাইকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই পৃথিবীতে আমাদের পদচিহ্ন যদি একটু গাঢ় করে রেখে যতে পারি তাহলে লোকজন বলবে, এই লোকটা খুব ভাল ছিল। আমাদের সেই চেষ্টা করা উচিত। তিনি বলেন, আমরা যে কাজটি করব সেটি যদি ঠিক করে করতে পারি তাহলে কোনো কাজই অসম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বে মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। সবকিছুই পসিবল (সম্ভব)। আমরা বলি ইম্পসিবল (অসম্ভব)। এই শব্দটাকে একটু যদি ভাগ করে বলি, ‘অ্যাই এম পসিবল’ হবে। সুতরাং আমাদের নেগেটিভ চিন্তা করার দরকার নেই। শুধু দরকার শুরু করা। রাইট ব্রাদার্স যদি শুরু না করতেন তাহলে বিমান আবিষ্কার হত না, আমরা কয়েক হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়েও যেতে পারতাম না।
রাশেদ রউফ বলেন, দেশে শিশুসাহিত্যের যে ধারা সেটাকে আরো গতিময় ও সুসংহত করার জন্য এই আয়োজন। যারা শিশুসাহিত্যিক তাদের এক জায়গায় করার চেষ্টা করেছি। আগেও চারবছর হয়েছে। যাদের পরিচয় শিশুসাহিত্যিক তাদের সবাইকে এক ছায়ার নিচে আনার চেষ্টা থাকে এই উৎসবে। এবার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিশুসাহিত্যিকরা এসেছেন। আমরা মনে করেছি সংক্ষিপ্ত আকারে এবার অনুষ্ঠান করবো। কিন্তু সবার অংশগ্রহণ আমাদের এই উৎসবকে করে তুলেছে আরো বর্ণিল।
অধ্যাপক এলিজাবেথ আরিফা মুবাশ্শিরা বলেন, এই উৎসব শিশুসাহিত্যিকদের উৎসব। শিশুদের চাওয়া–পাওয়া, শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত উপহার দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। শিশুদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। তাদের বইমুখী করতে হবে। একই সাথে শিশুদের আনন্দময় শৈশব উপহার দিতে হবে।
উদ্বোধনী দিনের প্রথম অধিবেশনে স্বরচিত ছড়া পাঠ করেন একাডেমির ফেলো শিশুসাহিত্যিক যথাক্রমে বিপুল বড়ুয়া, দীপক বড়ুয়া, উৎপলকান্তি বড়ুয়া, অরুণ শীল, জসীম মেহবুব, এয়াকুব সৈয়দ, সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, কেশব জিপসী, আজিজ রাহমান, আবুল কালাম বেলাল, মিজানুর রহমান শামীম ও অমিত বড়ুয়া। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করে উঠোন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও আনন্দধারা সাংস্কৃতিক একাডেমির শিশুশিল্পীরা।
দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘শিশু–কিশোরদের সাহিত্যমুখী করতে আমাদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক মর্জিনা আখতারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে আলোচনায় অংশ নেন অধ্যক্ষ তরুণ কান্তি বড়ুয়া, অধ্যক্ষ ছন্দা চক্রবর্তী, প্রাবন্ধিক নিজামুল ইসলাম সরফী, অধ্যাপক গোফরান উদ্দীন টিটু, প্রাবন্ধিক এসএম মোখলেসুর রহমান ও গল্পকার রুনা তাসমিনা।
বিকেলে শিশুসাহিত্যিক ও কথাসাহিত্যিক দীপক বড়ুয়ার সভাপতিত্বে ছড়া–কবিতা পাঠে অংশ নেন এক ঝাঁক ছড়াশিল্পী। সূচনা বক্তব্য দেন নাট্যকার, গল্পকার ও ছড়াকার কাসেম আলী রানা। সন্ধ্যা ৬টায় ‘আগামীর শিশুসাহিত্য’ বিষয়ে আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিপুল বড়ুয়া। আলোচক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক যথাক্রমে জসীম মেহবুব, আজিজ রাহমান, আবুল কালাম বেলাল, মিজানুর রহমান শামীম, কেশব জিপসী, অমিত বড়ুয়া, অধ্যাপক কাঞ্চনা চক্রবর্তী ও ইলিয়াস বাবর। সূচনা বক্তব্য দেন শিশুসাহিত্যিক ইসমাইল জসীম। সন্ধ্যা ৭টায় সৈয়দ খালেদুল আনোয়ারের সভাপতিত্বে ছড়া–কবিতা পাঠে অংশ নেন এক ঝাঁক ছড়াশিল্পী। সূচনা বক্তব্য দেন গল্পকার লিপি বড়ুয়া। উৎসব উপলক্ষে ‘শিশুসাহিত্য’ শিরোনামে ৩৯৬ পৃষ্ঠার একটি সমৃদ্ধ সংকলন প্রকাশ করা হয়।
আজকের অনুষ্ঠান : বিকেল সাড়ে ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী। প্রফেসর রীতা দত্তের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেবেন চট্টগ্রাম একাডেমির মহাপরিচালক প্রাবন্ধিক আমিনুর রশীদ কাদেরী, প্রাবন্ধিক নেছার আহমদ, ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, প্রাবন্ধিক জাহাঙ্গীর মিঞা, স্লোগান সম্পাদক মোহাম্মদ জহির, গল্পকার শিপ্রা দাশ ও এসএম আবদুল আজিজ। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ড. আনোয়ারা আলমের সভাপতিত্বে ‘বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি সম্মাননা’ প্রদান করা হবে। সম্মাননা পাচ্ছেন লেখক মাহমুদউল্লাহ, ছড়াশিল্পী আহমেদ জসিম, গল্পকার ইফতেখার মারুফ। আলোচক থাকবেন সুজন বড়ুয়া, ওমর কায়সার, এমরান চৌধুরী, অরুণ শীল, রমজান মাহমুদ ও কবি জসিম উদ্দিন খান।