শবে বরাত একটি অত্যন্ত পবিত্র এবং মর্যাদাপূর্ণ রাত, যা মুসলিম বিশ্বে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে উদযাপিত হয়। এটি হিজরি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বলা হয় এবং মুসলমানদের জন্য এটি বিশেষ একটি রজনী হিসেবে চিহ্নিত। ‘শবে বরাত’ ফারসি ভাষার শব্দ, যেখানে ‘শব’ অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ অর্থ মুক্তি, শান্তি ও সৌভাগ্য। এর আরবি প্রতিশব্দ ‘লাইলাতুল বরাত’ অর্থাৎ সৌভাগ্যের রজনী। এই রাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বান্দাদের মাফ করে দেন, বিশেষত যারা এই রাতটিতে ইবাদত ও তওবা করেন, তাদের জন্য।
বিশ্বের নানা প্রান্তে মুসলমানরা শবে বরাতের রাতটিকে বিশেষভাবে পালন করে, প্রার্থনা করে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং দোয়া করতে থাকে। কিছু ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যে এই রাতে কবুল হওয়া দোয়ার প্রতি বিশ্বাস রয়েছে, তাই অনেকেই বিশেষ দোয়া ও ইবাদত পালন করেন। শবে বরাত মুসলিমদের জন্য শুধু এক রাতের ইবাদত নয়, বরং তাদের আত্মশুদ্ধির এবং তওবা করার একটি সুযোগ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
শবে বরাতের পরের দিন শাবান মাসের ১৫ তারিখ। এ দিন অনেকেই রোজা রাখেন। এ সম্পর্কে একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন। প্রতি চান্দ্র মাসে তিন দিন রোজা রাখা সুন্নত। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখতেন, সাহাবীদেরকেও মাসে তিন দিন রোজা রাখতে বলতেন। (তিরমিজি ৭৬০; ৭৬৩)
প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা সুন্নত। এ তিন দিন মাসের শুরুতেও হতে পারে, মাঝেও হতে পারে, আবার শেষেও হতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু হাদিসে স্পষ্ট আছে যে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বিশেষভাবে মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ (যাকে আইয়ামে বীজ বলা হয়) রোজা রাখতে বলেছেন। (তিরমিজি ৭৬১)
হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, যে তিন দিনের কথা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, সেই তিন দিন রোজা রাখাই সর্বোত্তম। (ফাতহুল বারী, ১৯৮১)
সে হিসেবে প্রতি মাসের আইয়ামে বীজে রোজা রাখা সুন্নত। শাবান মাসও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই শাবান মাসের আইয়ামে বীজে (১৩, ১৪, ১৫) রোজা রাখাও সুন্নত। ১৫ তারিখ আইয়ামে বীজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ১৫ তারিখ রোজা রাখাও সুন্নত।
বাকি থাকল একটি বর্ণনায় বিশেষভাবে ও পৃথকভাবে ১৫ শাবান রোজা রাখার কথা বর্ণিত হয়েছে। (ইবনে মাজাহ ১৩৮৪) কিন্তু বর্ণনাটি শাস্ত্রীয় বিচারে দুর্বল। শাস্ত্রীয় বিচারে দুর্বল হওয়ার কারণে কেবল এই বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে ১৫ শাবানের রোজাকে পৃথকভাবে সুন্নত কিংবা মুস্তাহাব মনে করা সঠিক নয় বলে মতামত দিয়েছেন মুহাক্কিক আলেমগণ।
তবে, যেমনটি পূর্বে বলা হল, ১৫ তারিখ আইয়ামে বীজের অন্তর্ভুক্ত– এ হিসেবে এই দিনের রোজাকে (১৩ ও ১৪ তারিখের রোজাসহ) নিঃসন্দেহে সুন্নত মনে করা যাবে।
মোটকথা, সর্বাবস্থায় শাবান মাসের ১৫ তারিখে রোজা রাখা যাবে। পূর্বের দুই দিন তথা ১৩ ও ১৪ তারিখের সঙ্গে মিলিয়ে একসঙ্গে তিন দিন রোজা রাখা যেমন যাবে, তেমনি পৃথকভাবে কেবল ১৫ তারিখও রোজা রাখা যাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তিন দিন রাখাই উত্তম।
এমনিভাবে ১৫ তারিখ আইয়ামে বীজের একটি দিন হিসেবে ১৫ তারিখের রোজাকে সুন্নতও মনে করা যাবে। কিন্তু পৃথকভাবে শাবান মাসের ১৫ তারিখ বিশেষ একটি দিন, সে হিসেবে পৃথকভাবে এ দিনে রোজা রাখা সুন্নত– এমন ধারণা রাখা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে মুফতি তাকি উসমানী বলেন, ‘গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। হাদিসের বিশাল ভাণ্ডার হতে একটি মাত্র হাদিস এর সমর্থনে পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, ‘শবে বরাতের পরবর্তী দিনটিতে রোজা রাখ’। সনদ ও বর্ণনার সূত্রের দিক থেকে হাদিসটি দুর্বল। তাই এ দিনের রোজাকে এই একটি মাত্র দুর্বল হাদিসের দিকে তাকিয়ে সুন্নত বা মুস্তাহাব বলে দেয়া অনেক আলেমের দৃষ্টিতেই অনুচিত। তবে হ্যাঁ, শাবানের গোটা মাসে রোজা রাখার কথা বহু হাদিসে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১ শাবান থেকে ২৭ শাবান পর্যন্ত রোজা রাখার যথেষ্ট ফজিলত রয়েছে। কিন্তু ২৮ ও ২৯ তারিখে রোজা রাখতে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই নিষেধ করেছেন। নবীজি বরৈন, ‘রমজানের দু-একদিন আগে রোজা রেখো না।’ যাতে রমজানের জন্য পূর্ণ স্বস্তির সঙ্গে স্বতঃর্স্ফূভাবে প্রস্তুতি নেয়া যায়। কিন্তু ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনের রোজাই অত্যন্ত বরকতপূর্ণ।