নিউজ ডেস্ক:
পৃথিবীর সব পেশার মানুষ একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে জীবনপথে যাত্রা করে। ভালো-মন্দের মিশেলে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সঙ্ঘাত পায়ে পায়ে তৈরি করে বিচিত্র আনন্দ-বেদনার অভিঘাত। সেই বিপুল অভিজ্ঞতা যেকোনো মানুষকে পথের নির্মম অভিজ্ঞতা, বেদনার নিষ্ঠুরতা ও আনন্দ-বেদনার বিপরীত স্রোতে চালিয়ে নেয়। একজন দৃষ্টিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এখন প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে। সেখানে সে অফিসে কর্মরত কর্মচারী বা কর্মকর্তা। তার পরিচয় সাধারণ মানুষ। পরিবারের দায়বদ্ধতা তার মূল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অথচ একসময় একজন মানুষ যেন নিজের কাজকর্ম। দায়দায়িত্বের পাশাপাশি অন্য একজন হয়ে ওঠেন। সেখানে তিনি মাছবাজারের ক্রেতা, স্কুলের শিক্ষক, অথবা সাধারণ কর্মব্যস্ত মানুষ। অথচ তার মধ্যে সম্পূর্ণ অন্য একজনের পরিচয় নিজেকে জানান দেয়।
আমার মনে পড়ে, ছেলেবেলায় আম আঁটির ভেঁপু অথবা পথের পাঁচালীর খোলা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ জীবনযাত্রা। তার মধ্যে অসাধারণ কিছু নেই, শুধু একটা বিশাল গ্রামীণ প্রান্তর। রাশি রাশি কাশফুলে ছাওয়া নদীর তীর। তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে গ্রামীণ বালক-বালিকা, রেললাইন দেখার প্রগাঢ় আকাক্সক্ষায়। আসলে রেললাইন হলো জীবনের গতির প্রতীক চলমান তার শক্তির সঞ্চালন। পেছনে বিস্তৃত রয়েছে বিস্তীর্ণ গ্রামীণ জনপদ, শষ্যক্ষেত, উদার প্রকৃতির বিপুল বিস্তার। স্থিতি আর গতির এই দোলাচলে বিশ্ব তার নব নব চিত্রকল্প সৃষ্টি করে চলে। আর যে ব্যক্তিটি ওই জীবনের বৈচিত্র্য উপলব্ধি করে নিজেকে নিবিষ্ট করে জীবন আচরণের নদী, সাগর, পাহাড় এবং আনন্দ-বেদনায়। এভাবে প্রতি মুহূর্ত বদলে বদলে এক নতুন শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। অর্থাৎ লেখক হয়ে ওঠে।
এ এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। কেবল একজন লেখকই পারেন এভাবে নিজেকে ভেঙেচুরে গড়তে।
লেখক এক সর্বত্রগামী শক্তির প্রতিনিধি। যে তার অজানিতে চলতে শুরু করে পৃথিবীর পথে। সে পথ তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় পারিপার্শ্বের অসাধারণ দৃশ্যাবলির সঙ্গে এবং সেই সঙ্গে জীবনের যা কিছু বোঝার মতো, হৃদয়ের সাথে তার পরিচয় ঘটে। বিচিত্র দৃশ্যাবলি, প্রকৃতির ঐশ্বর্য এবং তার উদার সৌন্দর্যÑ সবই মানুষের এক এক পর্যায়ে আপন হয়ে ওঠে।
আমার বিশ্ববিচরণকারী মানসলোকের বিস্ময় ও নব নব অভিজ্ঞতার ভূমিকায় আমি হাতে পাই এক প্রাচীন গ্রন্থ যার নাম ছিলÑ স্থাবর। লেখক এই গ্রন্থে লিখেছেন মানবজাতির আত্মপরিচয় খোঁজার গল্প। মানুষ তার আদিম জীবনাচরণে বাঁচার যে যুদ্ধ, তাই ছিল তার মূল অন্বেষণ। কয়েক হাজার বছর ও যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির বৈপরীত্যের মধ্যে বেঁচে থাকা, টিকে থাকার বিচিত্র ঘটনার ক্রমবিবর্তন গুহাবাসী মানুষের জীবনের এক অনন্য প্রতিবিম্ব। আত্মসমাহিত পূর্বপুরুষদের সে ইতিহাস টিকে থাকার যুদ্ধ, প্রতিহিংসা ও অধিকারবোধের অনন্য প্রতিচ্ছবি লেখক।
ঠিক একই বিস্ময়বোধ নিয়ে গড়ে ওঠে ভলগা থেকে গঙ্গা, রাজনীতি, যোদ্ধার জীবনযাত্রা, গুহাবাসী মানুষের গৃহী হয়ে ওঠা জীবনের পথপরিক্রমা।
লেখক কোন ইচ্ছা থেকে জীবনচিত্র ধরে রাখার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন?
সমগ্র পৃথিবী এক বিপুল সৃষ্টির ঐশ্বর্যে মণ্ডিত। সময় যত এগিয়েছে, সভ্যতার মুকুটে নতুন পালক উঠেছে। অর্থাৎ মানুষ সময়কে ধরে রাখতে ব্যাকুল হয়েছে। নগরসভ্যতা, গুহাবাসী মানুষের চিত্রকলা, গুহা-উৎকীর্ণ বর্ণমালা, এক্সরের মধ্য দিয়ে মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠেছে সময়ের ঘটনাবলির, বিজ্ঞানের সাক্ষ্য ও ইতিহাসের সৃষ্টির কারিগর। প্রথম লেখার আগ্রহ থেকেই মানুষ হয়ে ওঠে সৃজনশীল কর্মী। আমাকে আমি সময়ের বন্ধু হিসেবে প্রকাশ করতে চাই, এটি ছিল মূল আশা ও আকাক্সক্ষা। এই হয়ে ওঠাই তার পরিচয়ের মূল কথা।
ইতিহাস দেখলে জানতে পারি, মানবসভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ নিজেকে চিহ্নিত করেছে নানা ধরনের লিপিচর্চার মধ্য দিয়ে। একসময়ে মানুষ সভ্যতার বিভিন্ন স্তরের পথ অতিক্রম করে। বিভিন্ন দেশে রাজসভায় কবিতা ও ইতিহাসচর্চার একটা প্রথা গড়ে ওঠে। দেশে দেশে চারণকবিরা জীবনের কথা বর্ণনা করে কাব্যচর্চা করেন। প্রাচীন গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে ইতিহাসের প্রয়োজনে। মিসরীয় সভ্যতা, রোমান বা পারসিক সভ্যতা গড়ে ওঠে সময়ের প্রয়োজনে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার চর্চার মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ স্বাভাবিক জীবনচিত্র, যুদ্ধবিগ্রহ ও বিচিত্র রাজন্যবর্গের পরিচয় জানতে আগ্রহী হয়েছে। সভ্যতার দাবি অনুযায়ী সাধারণ জ্ঞানচর্চার আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে উঠেছে। চিত্রকলা, নৃত্যগীত, মানুষের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। প্রাচীন নেপালের রাজদরবারে পাওয়া গেছে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার কাঠামো।
এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা হচ্ছে মানবসভ্যতার অন্তরালে সেই ব্যক্তির যিনি রাজত্ব, রাজনীতি, হিংস্রতা, শক্তির প্রতীক না হয়েও জীবনের সমান্তরালে নিজের অজানিতেই গড়ে তুলেছেন সৃজনশীলতার স্রোতোধারাÑ যা কাব্য, নাট্যকলা, ইতিহাস সব কিছুকে ধরে রাখে। অর্থাৎ সৃজনশীল সাহিত্যের চর্চা এভাবেই চলে আসছে লেখকের হাত ধরে।
বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখি, দান্তের ‘দি ডিভাইন’, শেক্সপিয়রের অমর ট্র্যাজেডি এসব সৃষ্টির পেছনে রয়েছে সৃষ্টিশীলতার তৃষ্ণা। মানুষ যা জেনেছে, অনুভব করেছে, তাকে মানুষের কথায় ফুটিয়ে তোলার জন্যই পারস্যের শাহনামা, প্যারিসের বিদ্রোহ নিয়ে লেখা হয় টেল অব টু সিটিস ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক, প্রিজনার অব জেন্দা। রাজনীতি ও পৃথিবী কাঁপানো যুদ্ধের ভয়াবহতা ফুটে ওঠে অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, ত্রি কমরেডস। আসলে পৃথিবীর মানুষ কোনো ঘোষণা ছাড়াই লেখালেখি শুরু করেছিল নিজের মনের তাগিদে। ক্রমে ক্রমে তা সাধারণ মানুষ ও তার জীবনকে নিজের অজান্তেই অধিকার করে নেয়। সাধারণ জীবনে জ্ঞানচর্চা সেই প্রাচীন ইচ্ছা থেকেই চলতে শুরু করে। একজন লেখক মানুষের কাছাকাছি থেকে মানুষের কথা ভাববে, দেখবে এবং সবার হৃদয়ে পৌঁছে দেবে এটাই ছিল মূল স্রোতোধারার কথা।
এখানে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন। তা হলো- জীবনের মধ্যে গভীরভাবে অনুপ্রবেশ না করলে লেখক সৃষ্টি করতে পারেন না। প্রাচীন কাব্য, সাহিত্য রচনার মূলে রয়েছে জানার ও শেখার ইচ্ছা। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, মালিক মুহম্মদ, জায়সী, আলাওল, রুমি, জামি- সবার মূল কর্মকাণ্ড হলো সৃজনশীলতা ও জানার তৃষ্ণা। দেশে দেশে বাণিজ্য পোত যেমন সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে, সেই সঙ্গে যাত্রা করেছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নানা দেশের ভাষা, সাহিত্য ও মানুষে মানুষে আত্মিক সংযোগ।
তাই নদী ও সাগর বিশ্বসৃজনশীলতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোগপথ। তাত্ত্বিক সংযোগপথও বটে।
কবি, সাহিত্যিক তথা লেখক মাত্রেই নদীর মধ্য দিয়ে খুঁজে পান মনের যাতায়াতের পথ।
আমার মনে পড়ে, বাংলাদেশের জনজীবন গভীরভাবে নদীসম্পৃক্ত। রবীন্দ্র-সাহিত্য যেমন তার সাহিত্যকে নদীর আত্মীয়তার নিকটতম প্রতিবেশী মনে করেছেন; তেমনটি আর যেন কিছুতে নয়। আবার নজরুল তার বিরহে, সৌন্দর্যে সুখেদুঃখে সমুদ্রকে দিয়েছেন অসাধারণ স্থান। খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকদের লেখায়ও তেমনি চোখে পড়ে। আমাদের দেশ নদীবহুল। প্রাচীন লেখায় যেমন পেয়েছি ভলগা থেকে গঙ্গা; তেমনই পরবর্তীকালে পেয়েছি তিতাস একটি নদীর নাম। নদীতীরের জনজীবন, যুদ্ধ-বিগ্রহ এসবের পাশাপাশি চোখে পড়ে সাধারণ জীবনচিত্র। আল মাহমুদের সাহিত্যিক শওকত ওসমান লেখেন জননী। শওকত আলী লেখেন উদ্বাস্তু উন্মূল জীবন নিয়ে তার উপন্যাস। শাহেদ আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ নতুন নতুন বিষয় সৃষ্টি করেছেন। আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি, সৈয়দ ওয়ালি উল্লার চাঁদের অমাবস্যা, সৈয়দ শামসুল হকের নূরল দীনের সারা জীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। গণজীবনের বিচিত্র রূপকল্প দেখা যায় আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত, কাবিলের বোন, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাইতে। খোন্দকার ইলিয়াস ‘আত্মার ক্ষুধার উপমা’ তার উপন্যাসে বিশাল আবহে ফুটিয়েছেন। যিনি লেখেন, তিনি পূর্ণ জাগ্রত সচেতন চলমান মানুষ।
বিশাল একটি ব্যাপার হলো- লেখক নামের ব্যক্তির অস্তিত্ব গড়ে ওঠা।
তাই বলছিলাম, লেখক ও লেখা এক অসাধারণ সৃজনশীলতার কাহিনী, যা বিশাল মানুষ জাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গড়ে তোলেন বিশাল জীবনধারা। তার মধ্যে লেখক এক হৃদয়বান, কুশলী সৃষ্টিশীল মানুষ। ভিড়ের মানুষ হয়েও যে এক ও একক।
তাই লেখক অসামান্য ও চির অমর। চিরদিন গতিশীল।