নিউজ ডেস্ক:
‘লাভেউল পার আমো’ ফ্রেঞ্চ শব্দ। ইংরেজিতে Blinded Love. বাংলায় যার অর্থ প্রেমে অন্ধ। ২০১৬ সালে ইতালির জনপ্রিয় ব্র্যান্ড গুচি তাদের পণ্যে, বিশেষ করে নারীদের জামা-কাপড়ে ‘লাভেউল পার আমো’ শব্দটি ব্যবহার করে। বিশ্বে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে এটি তাদের একান্ত প্রয়াস!
সত্যিই প্রেম অন্ধ। সত্যিকারের ভালোবাসা বিরল এবং ভাগ্যবান মানুষ তারাই যাদের প্রেম চিরকাল স্থায়ী। রজার ফেদেরার ও মিরকা ভাভরিনেক- তারকা এ জুটি শাশ্বত সত্য ভালোবাসার প্রতীক, অমর সত্য প্রেমের সংক্ষিপ্তসার। তাদের প্রেম কাহিনী পৌরাণিক কোনো উপাদান যা জেন অ্যাসটন বা ব্রোন্টে সিস্টার্সের উপন্যাসের সঙ্গে তুলনীয়। হয়ত এ যুগের মতো তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি কিংবা হিরো-হিরোইনের মতো নাটকও করতে পারেনি। কিন্তু তাদের ভালোবাসা, রূপকথার রাজ্যে এক পথে চলা, নিজেদের কাছাকাছি রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস নতুনের কেতন ওড়ানোর মতোই!
রজার ফেদেরার কিংবা মিরকা ভাভরিনেককে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। টেনিস কোর্টে তাদের জুটির মেয়াদ মাত্র কিছু দিনের। কিন্তু কোর্টের বাইরে ষোলো বছরের ‘মিক্সড ডাবলস জুটি’ বেঁধেছেন দুজন। ১৯৯৭ সালে দুজনের প্রথম পরিচয়। সুইজারল্যান্ডের টেনিস সেন্টার বেইলে দুজন প্রথম মুখোমুখি হন। হায়-হ্যালোতে প্রথম পরিচয়। সুইজারল্যান্ডে মিরকা যখন অনুশীলন করতেন তখন সব সময় রজার তাকে ফলো করতেন। মিরকার জন্য জোরে জোরে ব্যাকস্ট্রিট বয়েজের গান গাইতেন। সুর ও তাল কিছুই মিলত না কিন্তু গানের ভাষা মিরকাকে বুঝাতে চাইতেন।
‘আমি আমার কাজ ঠিকমত করতে পারতাম না। ও প্রচণ্ড কথা বলত। গান গাইত। আশেপাশে ঘোরাফেরা করত। যদিও ওর গানের কোনো সুর মিলত না। গানগুলো যে আমার জন্য গাইত সেগুলো বুঝতে পারতাম।’- বলেছেন মিরকা। ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকে দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হন। অলিম্পিকে রজার সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেললেও মিরকা প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেন। টমি হাসের কাছে সেমিফাইনালে রজার হারলেও মিরকার ভালোবাসা জিতেছিলেন। মিরকার ভালোবাসা তাকে স্বর্ণের স্বাদ ভুলিয়ে দিয়েছিল। অলিম্পিক গেমসের পর্দা নামার ঠিক আগে রজার নিজের ভালোবাসা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। খেলোয়াড়দের লিঁয়াজো অফিসার মিতঝি ইনগ্রামকে বলেন, ‘মিতঝি অপেক্ষা করো। আমি বিশেষ একজন মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেব।’
মিতঝি তখন বলেন, ‘এগিয়ে যাও।’ এরপরই মাইক নিয়ে রজার মিরকাকে পরিচয় করিয়ে দেন ‘আমার জীবনের বিশেষ একজন’ বলে।
রজার এবং মিরকা অলিম্পিকে ম্যাচ হেরেছেন, সম্ভবত ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন অলিম্পিকের স্বর্ণ হারিয়েছেন। কিন্তু ওই হারানোর মধ্যেই সুখ খুঁজে বের করেছেন দুজন। ‘গেইনিং ইচ আদার্স লাভ অ্যান্ড লুসিং ওউন হার্ট ফর ওয়ান এনাদার। প্রোবাবলি নিউ বিগিনিং অফ সামথিং মোর বিউটিফুল।’
একটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, রজার ফেদেরার থেকে ৩ বছর বড় মিরকা। সম্পর্কের শুরু থেকে এ বিষয়টি কোনো প্রভাব ফেলেনি। পরবর্তীতেও না। সিডনি অলিম্পিকের পর হোপম্যান কাপে সর্বপ্রথম তারকা টেনিস জুটি মিক্স ডাবলসে মাঠে নামেন। পারফরম্যান্স ভালো না হলেও জুটি বাঁধার কারণে তারা একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে আসেন। কোর্টের এ জুটি আরেকটু লম্বা হতো। কিন্তু ২০০২ সালে তা থেমে যায়। মিরকার ক্যারিয়ার পায়ের ইনজুরির কারণে মাঝ পথে আটকে যায়। অন্য দিকে রজারের সূচক তখন উর্ধ্বগামী। আন্তর্জাতিক টেনিসে রজার সে সময় ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। মিরকা বুঝতে পারছিলেন টেনিসের পরবর্তী ‘রাজা’ হবে তার মনের মানুষটি।
কোর্টে জুটি বাঁধতে না পারা মিরকা রজারের ম্যানেজার হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রজার কখন কী করবেন, কোন ব্র্যান্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন, কোন বিজ্ঞাপনে অংশ নেবেন তা ঠিক করে দেন। মোট কথা রজারের পারসোনাল অ্যাসিসট্যান্টের থেকেও বেশি দায়িত্ব পালন করে আসছেন মিরকা। এ সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন? ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি এক সাক্ষাৎকারে রজার বলেছেন, ‘মিরকা আমার থেকে দূরে থাকতে চাইত না। আমারও ওর থেকে দূরে থাকতে ভালো লাগত না। এ কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বছরের পর বছর কীভাবে একসঙ্গে থাকা যায়। আমি খুব খুশি যে ও এভাবে আমার সঙ্গে আছে। তাকে ছেড়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা সত্যিই কঠিন কাজ। হয়ত অসম্ভব একটি কাজ।’
সেই থেকে একসঙ্গে ওঠা-বসা, পথ চলা, পৃথিবী ঘুরে দেখা আর একের পর এক গ্র্যান্ডস্লাম জেতা। তবে ২০০৮ সালে মিরকা সবচেয়ে বড় ‘গ্র্যান্ডস্লাম’ উপহার দেন রজারকে। ২০০৮ সালের শেষ দিকে মিরকা জানান, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। রজার এ খবর শোনার পর আনন্দে আত্মহারা। তাৎক্ষণিক বিয়ের প্রস্তাব দেন মিরকাকে। লাস্যময়ী মিরাকাও রাজী হয়ে যান। ২০০৯ সালের ১১ এপ্রিল দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মাত্র ৩৯ অতিথির সামনে দুজন আংটি বদল করেন। বিয়ের ছবি প্রকাশ করেন সুইজারল্যান্ডের শীর্ষ ম্যাগাজিন সুইজার ইলাসট্রিয়াট। তারকা দম্পত্তি নিজেদের বিয়ের ছবি ম্যাগাজিনটির কাছে বিক্রি করেন এবং প্রাপ্ত অর্থ রজার ফেদেরার ফাউন্ডেশনে জমা করেন।
বিয়ের আগে থেকেই রজারের ছায়া হয়ে ছিলেন মিরকা। বিয়ের পর কাছে থাকার আবেদন আরও বেড়ে যায়। অন্তঃসত্ত্বা হলেও কখনো রজারকে একা ছাড়েননি। ২০০৯ সালে উইম্বলডন ওপেনের ফাইনালে মুখোমুখি রজার ও এ্যান্ডি রডিক। ৪ ঘণ্টা ১৭ মিনিটের লড়াই হয় দুজনের মধ্যে। কেউ কাউকে ছাড় দেবেন না পণ করে রেখেছিলেন। ম্যাচটি জিতে রজার র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠে যান। সময়ের হিসেবে ম্যাচটি রেকর্ডও গড়েছিল। সে সময় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন মিরকা। ম্যাচের পুরোটা সময় গ্যালারিতে গলা ফাঁটান তিনি। ধারাভাষ্যকার, দর্শক, ম্যাচ অফিসিয়াল, আয়োজক থেকে শুরু করে সবাই ম্যাচের থেকেও বেশি মিরকাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু মিরকা ‘আয়রন ম্যানের’ ভূমিকায়। প্রেমিক, স্বামীর পাশে থেকে ম্যাচ জিতিয়েছেন।
ট্রফি জেতার ১৮ দিন পর, ২৩ জুলাই ২০০৯ সালে প্রথম বাবা হন রজার। মিরকা যমজ সন্তানের জন্ম দেন। দুজনই কন্যা, মাইলা রোজ ও চারলিন রিভা। ২০১৪ সালের ৬ মে আবারও মিরকার কোলজুড়ে আসে যমজ সন্তান। এবার দুজনই ছেলে। দুজনের নাম রাখেন লিও ও লেনি।
কথায় বলে, প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর ভূমিকা থাকে। যারা বিশ্বাস করেন না তারা রজার ফেদেরারকে দেখুন। টেনিস কোর্টের রাজাও নিজেও এটি স্বীকার করেছেন পুরো বিশ্বের সামনে- ‘হয়ত সবাই বলবে আমি সেরা কিন্তু আমার মতে মিরকা সেরা। ওই তো আমাকে সেরা বানিয়েছে’ বলেছেন তিনি।
শূন্য থেকে শীর্ষে রজার ফেদেরার। মিরকা আছেন ছায়াসঙ্গী হয়ে। কখনো কখনো মিরকা হয়ে যান কোচ, কখনো ট্রেনার। সবশেষে অস্ট্রেলিয়া ওপেনের আগে দীর্ঘদিন ইনজুরিতে ছিলেন রজার। ৩৫ বছর বয়সি রাজাকে কোর্টে ফেরাতে দিনরাত কষ্ট করেছেন ৩৮ বছর বয়সি মিরকা। এ সময়ে একটুও দমে যাননি আয়রন লেডি। যার ফল পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়া ওপেনে। পুরো বিশ্ব যখন বুড়ো রজারকে নিয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন মিরকা পাশে থেকে অভয় দিয়েছেন, বিশ্বাস জুগিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সেমিফাইনালে মিরকার গোলাপি সোয়েটারে লেখা ছিল: ‘লাভেউল পার আমো’ অর্থাৎ অন্ধ প্রেম। সত্যিই মিক্স ডাবলস জুটি প্রেমে অন্ধ। মিরকা রজারের সেরাটা বের করে এনেছেন, রজারও একই কাজটি করেছেন। রজার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি যদি কোনো ম্যাচ জিতি মনে হয় মিরকাকে জিতেছি।’ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের পর লকাররুমে ঢুকতেই রজারকে জড়িয়ে ধরেন মিরকা। আলিঙ্গন ভেঙে দুজন দুজনকে চুমুও খেয়েছেন।
ষোলো বছর মিক্স ডাবল জুটি একে অপরকে ভালোবাসায় বেঁধে রেখেছেন। মাঠে খেলেছেন রজার। মাঠের বাইরের সকল কাজ সামলেছেন মিরকা। আজকের রজার ফেদেরারের উঠে আসার পেছনেও মিরকার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তারা সুন্দর সত্য সম্পর্কের সংক্ষিপ্তসার। তাদের ভালোবাসা স্থায়ী, শর্তহীন, অক্ষয়, নিঃশর্ত। চিয়ার্স রজার-মিরকা।