নিউজ ডেস্ক:
কোনো কোনো বিখ্যাত লোক মানুষদের শিক্ষা দেন যে, আল্লাহ কুরআনে বলেছেন- ‘লাকুম দিনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন’ মানে, সবাই যার যার ধর্ম পালন করছে, আমি আমার ধর্ম পালন করি, অন্যেরা তাদের ধর্ম পালন করে। অর্থাৎ তারা বলতে চান যে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিষ্টান সবাই সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে নিজ ধর্ম পালন করছে। মৃত্যুর পর সবাই তাঁর কাছে ধর্ম মানার পুরস্কার লাভ করবেন। এ স¤পর্কে মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন-
১. বল, হে কাফিররা! ২. তোমরা যার ইবাদাত করো, আমি তাঁর ‘ইবাদাত করি না, ৩. আর আমি যাঁর ‘ইবাদাত করি তোমরা তাঁর ইবাদাতকারী নও, ৪. আর আমি তাঁর ইবাদাতকারী নই তোমরা যার ইবাদাত করে থাক, ৫. আর আমি যাঁর ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও, ৬. তোমাদের পথ ও পন্থা তোমাদের জন্য (সে পথে চলার পরিণতি তোমাদেরই ভোগ করতে হবে) আর আমার জন্য আমার পথ (যে সত্য পথে চলার জন্য আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, এ পথ ছেড়ে আমি অন্য কোনো পথ গ্রহণ করতে মোটেই প্রস্তুত নই)।
কয়েকটি হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সা: যখন মক্কার মূর্তিপূজারীদের নানান দেবদেবীর পূজা ত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আহ্বান জানাতে লাগলেন, তখন কাফিরদের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড বিরোধিতার সৃষ্টি হলো। এ সময় তারা রাসূল সা:-এর কাছে একাধিক প্রস্তাব পেশ করল।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বর্ণনা করেন : কুরায়শরা নবী করীম সা:কে বলল- আমরা আপনাকে এত ধন সম্পত্তি দিব যাতে আপনি সর্বাপেক্ষা বড় ধনী ব্যক্তি হয়ে যাবেন, আপনার পছন্দসই যেকোনো মেয়ের সাথে আপনার বিয়ে স¤পন্ন করে দেবো। আমরা আপনার নেতৃত্ব মেনে আপনার পেছনে চলতে প্রস্তুত। তবে সেজন্য শর্ত এই যে, আপনি আমাদের মা’বুদদের বিরোধিতা ও তাদের দোষত্র“টি বর্ণনা করা হতে বিরত থাকবেন। আমাদের এ প্রস্তাব মেনে নিতে আপনি যদি প্রস্তুত না হন, তাহলে এর বিকল্প প্রস্তাবও আমরা আপনার সম্মুখে পেশ করছি। এ প্রস্তাব মেনে নিলে আপনার পক্ষেও ভালো, আমাদের পক্ষেও ভালো। নবী করিম সা: জিজ্ঞেস করলেন- তোমাদের সেই বিকল্প প্রস্তাবটি কী? তারা এর জওয়াবে বলল- আপনি এক বছরকাল আমাদের মা’বুদ লাত ও উয্যার ইবাদত করবেন আর এক বছরকাল আমরা আপনার মা’বুদের ইবাদত করব। নবী করীম সা: বললেন- তোমরা অপেক্ষা করো, এ বিষয়ে আমার মা’বুদের কাছ হতে কী নির্দেশ আসে, আমাকে সব আগে তাই দেখতে হবে। এ প্রসঙ্গেই ওহি নাজিল হলো- আর সেই সঙ্গে আরো নাজিল হলো :
বল : হে মূর্খরা! তোমরা আমাকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগি করতে বলছ ([সূরা যুমার, আয়াত) ইবনে জারির, ইবনে হাতিম, তাবারানি]।
এসব বর্ণনা থেকে জানতে পারা যায় যে, কাফির-কুরায়শরা বিভিন্ন দফায় এ ধরনের প্রস্তাব পেশ করেছিল। এ কারণে এ স¤পর্কে একেবারে চূড়ান্ত কথা বলে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। এই প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যেই সূরাটি নাজিল হয়েছিল।
বস্তুত কাফিরদের ধর্মমত, পূজা-উপাসনা এবং তাদের উপাস্য দেবদেবীর সাথে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্কতা, অসন্তুষ্টি ও অনমনীয়তার চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই সূরাটি নাজিল হয়েছিল। কুফরি ধর্ম ও দ্বীন-ইসলাম যে পুরোমাত্রায় পরস্পরবিরোধী এবং এ দু’টির কোনো দিক দিয়েও যে মিল হতে পারে না, এ কথাটি তাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়ার আবশ্যকতা ছিল। কাজেই এ সূরাটিকে বিভিন্ন ধর্মের মাঝে সমঝোতা সৃষ্টির ফর্মুলা পেশকারী সূরা মনে করা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এ কথাটি যদিও শুরুতে কুরাইশ কাফিরদের সম্বোধন করে তাদের সমঝোতা প্রস্তাবের জওয়াবস্বরূপ বলা হয়েছিল, কিন্তু এর মূল বক্তব্য কেবলমাত্র তাদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। কুরআন মজিদের এ সূরাটি কিয়ামত পর্যন্ত সব মুসলমানকে এই চিরন্তন শিক্ষা দান করছে যে, কুফর যেখানে যে রূপেই থাকুক না কেন, মুসলমানদের তা থেকে নিজেদের কথা ও কাজের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীনতা ও বর্জনের ঘোষণা দিতে হবে। দ্বীনের ব্যাপারে মুসলমানেরা যে কাফিরদের সাথে কোনোরূপ আপস-রফা ও সন্ধি-সমঝোতার আচরণ গ্রহণ করতে পারে না, তা কোনোরূপ উদারতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ব্যতিরেকেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে হবে। কেননা কুফরি বা কাফিরি আদর্শ ও রীতিনীতির প্রতি অসন্তোষ ও তার সাথে চূড়ান্ত নিঃসম্পর্কতা ঘোষণা করা মুসলমানের প্রতি ঈমানের শাশ্বত দাবি। কোনো ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষেই এ দাবি উপেক্ষা করা কিছুতেই সম্ভবপর নয় (তাফহিমুল কুরআন, সূরা কাফিরুনের তাফসির দ্রষ্টব্য)।
ইসলামের শিক্ষা অনুসরণে মুসলমান তার প্রতিবেশী মুশরিকের সাথে ভালো আচরণ করবে, পার্থিব যাবতীয় কাজে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে, তার বিপদ আপদে দৌড়ে যাবে, তার সুখে-দুঃখে পাশে থাকবে। উভয়ের মাঝে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখবে। কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রে দু’জনের মাঝে পার্থক্য এতই বিশাল যে, তা উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর সাথে তুলনীয়। মুশরিকের সবচেয়ে উত্তম কাজ হচ্ছে, পুতুলের পূজা করা। আর একজন মুসলমানের জন্য দুনিয়ার সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ হচ্ছে পুতুলের পূজা করা। মূর্তির পূজাকারী কোনো মুসলমান যদি আল্লাহর কাছে ক্ষমা না চেয়ে মারা যায় তাহলে সে হবে জাহান্নামের অধিবাসী। যে কাজ হিন্দু ধর্মে সবচেয়ে প্রশংসিত, একই কাজ ইসলাম ধর্মে সবচেয়ে ঘৃণিত। তাওহিদ ও শিরক গলায় গলায় মিলে চলবে ইসলাম ধর্মে এটার কোনোই সুযোগ নেই। কোন্ ধর্মটি আল্লাহর অনুমোদিত ও গৃহীত তা তিনি কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন : আল্লাহর নিকট মনোনীত ধর্ম তো ইসলাম (সূরা আলে ইমরান : ১৯ আয়াত)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন : আর যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইবে কখনো তার সেই দ্বীন কবুল করা হবে না এবং আখেরাতে সে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে (সূরা আলে ইমরান, ৮৫)।
মূর্তিপূজা আর আল্লাহসহ বা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য ইবাদত অর্থাৎ আল্লাহর সাথে শিরক করার ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন : নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করা ক্ষমা করবেন না। এটা ছাড়া অন্য সব যাকে ইচ্ছে মাফ করবেন এবং যে আল্লাহর সাথে শরিক করল, সে এক মহা অপবাদ আরোপ করল (সূরা নিসা, ৪৮)।
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করে তার জন্য আল্লাহ অবশ্যই জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন আর তার আবাস হলো জাহান্নাম। জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই (সূরা মায়েদাহ, ৭২)
রাসূল সা: বলেছেন : যে ব্যক্তি শিরক না করা অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি শিরক করা অবস্থায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে সে জাহান্নামে যাবে (সহিহ মুসলিম হা. নম্বর ২৬৬৩)।
এ ব্যাপারে আয়াতের সংখ্যা আর হাদিসের সংখ্যা এত বেশি যে, তা একত্র করলে একটা বড় গ্রন্থ হয়ে যাবে।
কাজেই এ ধারণার কোনোই ভিত্তি নেই যে, সব ধর্মই আল্লাহ পছন্দ করেন এবং গ্রহণ করেন।
মুসলমানদের বন্ধু কে আর শত্রুকে- এ ব্যাপারেও আল্লাহ বহু আয়াত নাজিল করে মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়েছেন, যাতে তারা শত্র“র মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলে ধ্বংসের গহ্বরে পতিত না হয়। কিন্তু যারা কুরআন মাজিদের কোনো তোয়াক্কা করে না, কুরআন খোলে না, বুঝে না, এমন মুসলমানদের শত্র“র প্রতারণার ফাঁদ থেকে বাঁচাবে কে? সূরা মায়েদার ৮২ নম্বর আয়াতটি পড়ুন।
আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিচ্ছেন : যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি মানুষের মধ্যে ইহুদি ও মুশরিকদের তুমি অবশ্য অবশ্যই সবচেয়ে বেশি শত্র“তাপরায়ণ দেখতে পাবে, আর যারা বলে ‘আমরা নাসারা’ তাদের তুমি যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য বন্ধুত্বে নিকটতর দেখতে পাবে, কেননা তাদের মধ্যে ইবাদতকারী আলিম ও সংসার বিরাগী আছে আর তারা অহংকারও করে না।
মুসলমানদের প্রচণ্ডতম শত্র“ হচ্ছে ইহুদি আর মুশরিকরা। এটাই খাঁটি কথা, এটাই সত্য, কিয়ামত পর্যন্ত এটাই সত্য। কিন্তু মুসলমানদের কিছু লোক অজ্ঞতার কারণে কিংবা নিজেদের উপায়হীন ও দুর্বল মনে করে বলে : ‘মুশরিকরা আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু, মানে মুশরিকরা আমাদের বন্ধু তো বটেই, কিন্তু যেন তেন বন্ধু নয়, এক্কেবারে অকৃত্রিম বন্ধু।’
বন্ধু চিনতে ভুল করলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বই ধ্বংসের মুখে পড়বে। তাই আমাদের এখনই সাবধান হওয়া উচিত।