নিউজ ডেস্ক:
বিশ্বচাপে অবশেষে নতিস্বীকার করেছেন মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো লিডার অং সান সু চি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উচ্চ পর্যায়ের দুই দিনের বৈঠক শুরু হয়েছে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোয়।
বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে আজ সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। নেপিদোয় সাংবাদিকদের মন্ত্রী বলেন, ‘আজকেও (গতকাল) ভালো আলোচনা হয়েছে। আশা করছি কাল (আজ) আমরা একটি চূড়ান্ত সমঝোতায় উপনীত হতে পারব। ’ মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর কার্যালয়ে মন্ত্রী কিয়াও তিন্ত সোয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর হোটেল লবিতে গণমাধ্যমকে এ কথা জানান মন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, বিষয়টির সুরাহা নিয়ে তিনি আশাবাদী। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন প্রথমবারের মতো মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘এথনিক ক্লিনসিং’ বা জাতিগত নিধন উল্লেখ করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইঙ্গিত দিয়েছেন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তারা গতকাল দিনব্যাপী তিনটি বৈঠক করেন। সকালে প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক। এরপর দুপুরে মিয়ানমার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।
বিকালে সেখানেই দুই দেশর কর্মকর্তারা তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলরের দফতরের মন্ত্রী খিও তিন্ত সোয়ে। বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক, মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শফিউর রহমান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মকর্তারা। বৈঠক শেষে দুই দেশের কোনো কর্মকর্তাই আলোচনার বিষয়ে সাংবাদিকদের কোনো কথা বলেননি। তবে মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানান, বেশকিছু বিষয় মাথায় রেখেই একটি চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা চলছে। এজন্য প্রাথমিকভাবে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া মসৃণ করতে বিভিন্ন ধারা, শর্ত নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। আজ রাজধানী নেপিদোয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গে মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো লিডার অং সান সু চির মধ্যে একটি চূড়ান্ত বৈঠক হবে। সেখানে রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত নেওয়ার বিষয়টিই প্রাধন্য পাবে। এ বিষয়ে সেখানেই একটি চুক্তি হতে পারে। এদিকে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শফিউর রহমান বাংলাদেশের একটি অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘বুধবার (গতকাল) সকালে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। ’ তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি বৃহস্পতিবার (আজ) একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পারব। ’ চুক্তিতে কী কী থাকতে পারে— জানতে চাইলে বলেন, ‘এটি এখন বলা যাবে না। ’
এর আগে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি মন্তব্য করেছিলেন রাখাইন রাজ্যে রাতারাতি শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এশিয়া-ইউরোপ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক উপলক্ষে ইতিমধ্যে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে মিয়ানমার সফর করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। বহুপক্ষীয় এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে গতকাল দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে এ বৈঠক শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু অং সান সু চিই নন, মিয়ানমারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলছেন। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে আশ্রয় নেওয়া ৬ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশে থাকা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার সবাইকে ফিরিয়ে দেওয়াই এ আলোচনার উদ্দেশ্য। বৈঠকের একটি সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের যে ডাটা বাংলাদেশ তৈরি করেছে তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘকে রাখতে চায়। সেই সঙ্গে ফেরত পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জাতিসংঘের সরাসরি অংশগ্রহণ চায় বাংলাদেশ।
মিয়ানমারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইঙ্গিত টিলারসনের : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘এথনিক ক্লিনসিং’ বা জাতিগত নিধন বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, এর ফলে রোহিঙ্গারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং সে কারণেই এর জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্টভাবে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা বিবেচনা করছে।
টিলারসন এমন একটা সময়ে এ মন্তব্য করলেন, যখন তার দিনকয়েকের মধ্যেই খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন। আগামী রবিবারই তার মিয়ানমার যাওয়ার কথা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের হাতে যা তথ্য এসেছে তা খতিয়ে দেখে ও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে উত্তর রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একটা জাতিগত নিধনযজ্ঞ ছাড়া আর কিছুই নয়। মার্কিন সেনেটন জেফ মার্কলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল দিন কয়েক আগে মিয়ানমার ও বাংলাদেশে সফর করে ফিরে এসেছেন। ওই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বলেছেন, তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-হত্যা-খুন-ধর্ষণের যে সব ঘটনা শুনেছেন তা তাদের গভীরভাবে বিচলিত করেছে।
এদিকে ভ্যাটিকান জানিয়েছে, পোপ ওই সফরে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং লেইং ও সে দেশের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি-র সঙ্গে বৈঠক করবেন।
বিবিসি বাংলা