নিউজ ডেস্ক:
অনলাইন ব্যাংকিং লেনদেন দ্রুত করার পাশাপাশি দেশের ব্যাংক খাতের মুনাফা বাড়াতেও সাহায্য করছে। কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করছে।
অর্থের গতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে। গত রবিবার রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক (আইটি) এক সেমিনারে গবেষকরা এসব কথা বলেন। সেমিনারটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান।উদ্বোধনকালে রাজী হাসান বলেন, ‘আইটি ছাড়া ব্যাংকিং কল্পনা করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। আগামীর ব্যাংকিং হবে পুরোপরি আইটিনির্ভর। ’ সে জন্য আইটি খাতকে আরো গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সেমিনারে ‘ব্যাংকের ব্যবসা ও মুনাফা বৃদ্ধিতে আইটির প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাপত্রটি তৈরি করেছেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলম, শিহাব উদ্দিন খান ও সহকারী অধ্যাপক কানিজ রাব্বি।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় সেমিনারে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের কারণে তহবিল ব্যয় কমেছে। আগে ১০০ টাকা সংগ্রহে ছয় টাকা খরচ হতো, এখন খরচ হয় মাত্র দুই টাকা। তিনি বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে এটিএম বুথের সংখ্যা বাড়ছে না। এ বিষয়ে নীতিগত পরিবর্তন আনা দরকার।
ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরফান আলী বলেন, মাত্র ৩২ শতাংশ মানুষের ব্যাংক হিসাব আছে। কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তিরই একটি করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। ব্যাংকিং খাতকে ডিজিটালাইজেশন না করলে কী সমস্যা হতে পারে তা ভাবার সময় এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন আলীও অনলাইন ব্যাংকিংয়ে জোর দেওয়ার কথা বলেন। বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলম বলেন, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংক ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু সরকারি ব্যাংকের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে।
মাহবুবুর রহমান আলম আরো বলেন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রচুর গ্রাহক গ্রামে। কিন্তু ব্যাংকটি অনলাইনভিত্তিক না হওয়ায় বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। এটি হতাশাজনক ও লজ্জার বিষয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এখন বছরে গড়ে ১৭০ কোটি বার লেনদেন হচ্ছে। আর আইসিটির কারণে অনলাইনে ২০০ কোটি বারের বেশি লেনদেন হচ্ছে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ব্যাংক খাতের একজন কর্মী এখন বছরে গড়ে ১০ হাজার লেনদেন সম্পন্ন করছে। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত ব্যাংকের একজন কর্মীর গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজারের কম। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত দেড় দশকে ব্যাংকের কর্মীদের কর্মদক্ষতা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
আইটিতে বিনিয়োগ করা ব্যাংক খাতের জন্য কতটুকু লাভজনক, মূলত সে বিষয় সামনে রেখে গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষণার প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত ২১টি ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে। আর সেকেন্ডারি বা প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক ও আইটির বিষয়ে গ্রাহকের মতামত জানতে দেশব্যাপী ৫০০ জন লোকের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের আইটি খাতে এক টাকা খরচ করলে তা কতটা মুনাফা নিয়ে আসে, সে বিষয়টিও গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইটিতে এক টাকা বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের জন্য তা ১৩৬ টাকার সমান উৎপাদনশীলতা তৈরি করে। এর বিপরীতে প্রযুক্তিবহির্ভূত খাতে এক টাকা খরচ করলে সেটি ৫৮ টাকার সমপরিমাণের উৎপাদনশীলতা নিয়ে আসে।
একইভাবে আইটি বিষয়ে জ্ঞান আছে এমন একজন কর্মীর পেছনে এক টাকা খরচ করলে ব্যাংকের আয় বাড়ে ২৫ টাকার সমান। সাধারণ একজন কর্মীর পেছনে এক টাকা খরচ করা হলে ব্যাংকের আয় বাড়ে ছয় টাকা। অর্থাৎ আইটিতে দক্ষ একজন কর্মীর পেছনে ব্যাংকের বিনিয়োগ চার গুণ বেশি লাভজনক।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ধীরে ধীরে আইটির ব্যবহার শুরু হয়। সেই সময় ব্যাংকের একজন কর্মী গড়ে ৪১ কোটি টাকা লেনদেন করত। সেটি ২০১৫ সালে প্রায় চার গুণ বেড়ে ১৬০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ লেনদেন সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে একজন কর্মীর আর্থিক লেনদেনের দক্ষতাও এ সময়ে প্রায় চার গুণ বেশি বেড়েছে।
কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফাও এ সময় বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো মুনাফা করলেও সরকারি ব্যাংকের লোকসানের কারণে সামগ্রিক ব্যাংক খাত লোকসানের মধ্যে ছিল। সেই অবস্থা থেকে ২০০০ সালে ব্যাংক খাতের মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি টাকায়। এ মুনাফা ২০১৫ সালে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
২৫ বছরের বেশি সময়ে ব্যাংক খাতের মুনাফা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে আইসিটি খাতের ভূমিকা নির্ধারণে বেশ কয়েকটি গাণিতিক সমীকরণ গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে মতামতভিত্তিক যে জরিপ করা হয়েছে, সেখানে গড়ে ৬১ শতাংশ গ্রাহক অনলাইন ব্যাংকিংয়ের বিষয়ে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ গ্রাহক বলেছে, তথ্য-প্রযুক্তির কারণে ব্যাংকের লেনদেনে ভুলের পরিমাণ কমে এসেছে। তবে অনলাইন লেনদেন করতে গিয়ে কোনো সমস্যার মুখে পড়লে তা সমাধানে ধীরগতির বিষয়ে গ্রাহকরা তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে।