নিউজ ডেস্ক:
ঝাপসা হয়ে আসে সাদাকালো ছায়াছবি, আর শোনা কিছু কথা, যা বিস্মৃতির অতলে ডুবে আংশিক ভেসে ওঠে প্রাত্যহিকতার উজানে, উন্মন বসে ভাবছে এসবই। এক মগ হ্যাজেলনাট ক্যাপাচিনো হাতে বসে থাকলে যেসব ভাবনা আসতে পারে।
ক্যাফের বাইরে পেতে রাখা চেয়ার টেবিল। সকাল দশটা বেজে আট মিনিট। শূন্যতায় ঘেরা যদিও চারপাশ, এক চিলতে রোদ পিঠে আঁকুপাকু উষ্ণতা ছড়িয়ে দিলে মনে হয়- কী ভালো সব! পঁয়তাল্লিশের উন্মনকে পড়ন্ত যৌবন বলা যায়। মনের বয়স পঁচিশ ছাড়িয়ে এগোয়নি।
লী এসে টেবিলের ওপর চকলেট ব্রাউনি রেখে মিষ্টি করে হাসল। ফিরে গেলনা। উন্মন প্রায়ই এখানে এসে কফি খেয়ে যায়। তাড়া থাকলে কাগজের প্যাকেটে মুড়িয়ে নেয় ডোনাট। লীর সাথেওর বেশ চেনা জানা হয়ে গেছে। উন্মনের ঘোরগ্রস্ত চোখ দেখে সে এ গিয়ে এসে বলল- `থিঙ্কিং `বাউটলাইফ? `ধরা পড়ে যাওয়া ধরনের হাসি হাসল উন্মন। লীর বয়স হবে সতের আঠার। ঝলমলে কালো চুলের মেয়ে। বাবা ব্রিটিশ, মা চাইনিজ। রোদে ওর গাল ব্লাশ করছে। ইউক্যালিপটাসের পাতা ছুঁয়ে হাওয়া নেমে এসে লীর চুলে মুখ ঘষে যায়। বড় মায়া!
উন্মনের ডান হাতে চিঠির খাম। সেটা টেবিলে রেখে লীকে বলল- বি মাই গেস্ট।-অন ডিউটি! সরি। কাঁধ উঁচু করে শ্রাগ করে লী। ট্রে হাতে ফিরে যায় ক্যাফেতে।
তিন মাস ধরে প্রতিদিন একবার এই খামটি স্পর্শ করেছে উন্মন। কিন্তু ভেতরের চিঠি বের করেনি, একটি বিশেষ দিনের অপেক্ষায়। খামটি নতুন। এয়ার মেইলের। সাদা আর চারিদিকে লাল নীল দাগ কাটা।
চিঠি এসেছে সিলেটের এক চাবাগান থেকে। লোভাছড়া নামাল নিছড়া কী যেন নাম। প্রেরকের সাথে ইমেইলে যোগাযোগ। অ্যান্ড্রয়েড এর স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়ালেই ইমেইল দেখা যাবে। কিন্তু ইচ্ছে যায় না উন্মনের। কেননা এখন সে কিছু ভাবছে। একটা হারিয়ে ফেলা কিছু, যা থেকে বেরিয়ে আসা যায় না এবং সে বেরিয়ে আসতে পারেনি আজও। চিঠিটা কারো পকেটে ছিল। কত হাত ঘুরে চিঠি গন্তব্যে পৌঁছেছে কিংবা এটি হয়তো গন্তব্য নয়। কিছু চিঠি যেখানে যেতে হবে, যার কাছে, সেখানে কোনোদিন যেতে পারেনা। খামের ওপরটা ধুধু করছে নাম ঠিকানার শূন্যতায়। হতে পারে আজই সেই বিশেষ দিন কেননা একটু পরই চিঠিটা উন্মোচিত হবে।
প্রাচীন কোনো সভ্যতার দুর্মূল্য নিদর্শন যেন। কাঁপছে ছেঁড়া চিঠি। উন্মনের হাত কাঁপছে না কি মৃদু বাতাসই দুলিয়ে গেল? অতদূর থেকে বোঝা যায় না। সাদা ছিল এক সময়, চার দশকে বয়স বেড়েছে চিঠির আর নিজেকে হলদে-রঙা করেছে ক্রমশ। কিছু জায়গা বাদামি হয়ে এসেছে। কয়েকটি শব্দ ঢেকে গেছে রক্তের ফোঁটায়। লেখা শুরু হয়েছে ‘প্রিয়মনু’ সম্বোধনে। উন্মন চিঠি পড়তে শুরু করেছে।
বাঁশ তলা ক্যাম্প থেকে তোমায় লিখছি, মন। চারপাশে গ্রেনেড, রাইফেল, গুলি। ওষুধ, ফিনাইল। কাগজ, কলম সব আছে শুধু মননেই। তাই আর লেখা হয় না। বৃষ্টি-কাদায় রাস্তায় আজ বেরোনোর উপায় নেই। এতে বরং ভালো হয়েছে তোমাকে লিখতে পারছি আর পাকবাহিনীও বৃষ্টি ভেজা হয়ে এদিকে আসবে না। এক রাত এক খালের ঠাণ্ডা পানিতে গলা অব্দি ডুবে দাঁড়িয়েছিলাম। ইশ! জমে গিয়েছিলাম। একটা সিগারেট যদি পেতাম তখন! কী নারকীয় পরিস্থিতি, তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিরস্ত্র মানুষের ওপর। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে কয়লা। রোজ খবর আসে, মুক্তির ছেলেদের খোঁজ করতে গিয়ে মিলিটারি আর রাজাকার ঘরে আগুন দিচ্ছে, গরু, ছাগল ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর যুবতী মেয়েদেরও। বাবা-মায়ের লাশের ওপর হামাগুড়ি দিল শিশু।
চিঠির ওপর সারি সারি লাশ ভেসে যায়। উন্মনের চোখের সামনে লাশের পর লাশে স্থবির হয়ে আছে নিরবধি বয়ে যাওয়া নদী। চোখ বাঁধা, পেছনে হাত বাঁধা, পেটে বিরাট গর্ত। জলে নৌকা এগোতে পারে না। লগি দিয়ে লাশ ঠেলে তবে এগোয়। কলমী ফুলের গন্ধ মুছে বাতাসে লাশের গন্ধ। রক্তের গন্ধ।
সারাটি রাত জলে দাঁড়িয়ে দেখলাম আলো আসছে হালকা। পূর্বদিগন্তে লাল সূর্য। সূর্য উষ্ণতা দিল। দেশকে স্বাধীন করার নবমন্ত্রে দীক্ষিত হলাম। এদেশের নাম হবে বাংলাদেশ। তুমি দেখেনিও, মন, বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। দুদিন আগে ভোর রাতের অপারেশানে আমরা দারুণ যুদ্ধ করেছি। গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল তাই বাধ্য হয়েই পিছু হটতে হলো। দখল করতে পারিনি তবে ওদের শেষ ডিফেন্সের প্রায় দুশ গজের ভেতর চলে যেতে পেরেছিলাম। শুনলাম ওরা নৌকা রেডি করে রেখেছিল। চার পাঁচটি। আমাদের প্রবল আক্রমণের মুখে ওরা পালিয়ে গেছে। ওরা ছিল প্রায় দেড়শ জন, আমরা চল্লিশ জনের ট্রুপ। আমাদের তেমন ক্ষতি হয়নি। শুধু মুনীরের পায়ে গুলি লেগেছে। এখন হাসপাতালে।
এটুকু পড়ে চেয়ার টানার শব্দে পাশ ফিরে উন্মন। তিন জন খুন খুনে বুড়ি কফি খেতে এসেছে। এক্কেবারে পথের পাঁচালীর ইন্দিরা ঠাকুরন। শুধু পরনে স্কার্ট-টপস, কানে ইয়ারিং, ঠোঁটে লিপস্টিক। আজকের মনোরম আবহাওয়া নিয়ে ওরা কথা বলছে। চিঠির দিকে তাকায়সে।
সেদিন মনে হলো তুমি আমায় ডাকছ। আসলে হয়েছে কী, অপারেশান শেষ করে ফিরে আসার পথে এক পুরনো পরিত্যক্ত বাড়িতে ক্ষণিক বিশ্রাম নেবার জন্য থেমে ছিলাম। তখনই চোখ বুজে এলো। কী দেখলাম জানো? তুমি জোর করে তসরের পাঞ্জাবি পরিয়ে দিচ্ছ আর আমি কিছুতেই পরতে চাইছি না। তোমার হাত দুটো আমি চেপে ধরলাম। তুমি নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে যেই হাত টান দিলে অমনি বাঁধন আলগা হয়ে ভেঙে পড়ছে খোঁপা। স্লো মোশানে খোঁপা থেকে রূপোর কাঁটা খুলে পড়ে যাচ্ছে, চুল বেয়ে নেমে একবার শাড়ির ভাঁজে থমকালো তারপর মেঝেতে। টুং! সেই বিকেলটা আবার আসবেতো? সব পেছনে ফেলে চলে এসেছি। বিশাল দাঁড়ি-গোঁফ-চুলের এই আমাকে তুমি চিনতেই পারবে না। তোমার শরীরটা কেমন এখন কে জানে? মনে আছেতো? ছেলে হলে উন্মন আর মেয়ে হলে আনমনা। দুটো নামেই তুমি কেমন মিশে আছো, মন, তাই না?
আগামীকাল অপারেশন আছে। যদি আর ফিরে না আসি, মন, মন আমার মনু, তুমি মাকে ছেড়ে যেও না। আমি ছাড়া মা’র আর কেউ নেই। মাকে ভালোবেসো। আমি যে মায়ের সাথে দেখাও করে আসতে পারিনি। দেশওতো একমা, তাইনা! সে মায়ের ডাকেই ঘর ছেড়েছি। মাকে স্বাধীন করার জন্যই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি। তুমি কিন্তু একদম কাঁদবে না। জানি, অনেক কাঁদিয়েছি। নিজেকে বুঝিয়ো। ন্যায় আর সত্যকে আঁকড়ে ধরো। তোমার জন্য। আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য। ভালো থেকো তুমি। অনেক আদর আর চুমু।
জয়বাংলা!
শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে উন্মন। কয়েকটি শালিক উড়ে গেল। শব্দহীন। এদেশের শালিকগুলো অবিকল বাংলাদেশের শালিকের মতো। সে লক্ষ্য করে না কখন বৃদ্ধারা কফি শেষ করে উঠে চলে গেছে আর সামনে চুপচাপ মুখে বসে আছে লী। আজ ১৬ ডিসেম্বর, সেটাও ভুলে গেছে। চিঠির শেষে লেখা ‘ইতি, তোমার নয়ন’। নয়নের আর ফেরা হয়নি।
নয়নকে দেখেছে উন্মন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, সাদাকালো ছবিতে। একটু যখন বড় হয়েছে। এই তবে বাবা! ছিপছিপে গড়নের এক যুবক। ভাসা ভাসা উজ্জ্বল চোখ। কই, একদম বাবা বলে মনে হয়নিতো! আবেগ নেই, অনুভূতি নেই। সবার মুখের কথা শুনে শুনে একটা ভাবমূর্তি নির্মিত হয়েছে। মিশে আছে গর্ব আর শ্রদ্ধা। বাবা যে কী কে জানে? ঝাপসা হয়ে আসে সাদা কালো ছায়াছবি, আর শোনা কিছু কথা, যা বিস্মৃতির অতলে ডুবে আংশিক ভেসে ওঠে প্রাত্যহিকতার উজানে, উন্মন বসে ভাবছে এসবই। এবার সে চোখ বুজে আর দেখে একটা সাগর। ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাস ঝিকিয়ে উঠলে ভেসে আসে জাদুর বোতল। বাবার সমস্ত অনুষঙ্গে ভরা এক চিঠি নিয়ে। পৃথিবীর তটরেখা ধরে এগিয়ে, সে চিঠি একবার স্পর্শ করলে জীবন খুলে যায় আর ইতিউতি, টুকটাক এই একটি মাত্র জীবনে নোনা জল আর হাওয়া ছাপিয়ে আসেমৃদু সোনালী সব আলো।চোখ মেলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডান হাতের তর্জনি দিয়ে বাঁ চোখের নিচে একটু মুছে নেয় উন্মন। ঠোঁট নড়লে বোঝা যায় একবার সে কাউকে ডাকলো- বাবা!