মিরাজ কী ও কেন

0
7

রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের ওপর চলছিল চরম নির্যাতন। খাজা আবু তালিব নবীজি (সা.)-কে কাফেরদের আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দিতেন। ঘরে নবীজি (সা.)-কে শান্তনা দিতেন খাদিজাতুল কুবরা (রা.)। কয়েকদিনের ব্যবধানে শ্রদ্ধেয় চাচা আবু তালিব ও প্রিয় স্ত্রী খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ইন্তেকাল করলেন। এরপর অনেক আশা নিয়ে তায়েফবাসীর কাছে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে গেলেন। তারা দাওয়াত কবুল করল না। ক্ষতবিক্ষত করল নবীজি (সা.)-কে। এমন কঠিন মুহূর্তে মহান আল্লাহ নবীজি (সা.)-কে বড় বড় নিদর্শন দেখিয়ে সম্মানিত করতে ডেকে নিলেন ঊর্ধ্বজগতে। সশরীরে, সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় ভ্রমণ করালেন আসমান জমিন-সহ ঊর্ধ্বজগত। স্বচক্ষে দেখালেন অনেক কিছু। যাকে মিরাজ বলা হয়।

মিরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা 

বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, হিজরতের এক বা দেড় বছর আগে এক রাতে নবীজি (সা.) নফল হিসেবে রাতের নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর খানায়ে কাবা সংলগ্ন ‘হাতিমে’ শুয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে দুই চোখ বন্ধ করলেন। এরই মধ্যে আগমন করলেন জিবরাঈল (আ.)। জাগ্রত করলেন নবীজিকে। আবে জমজম দ্বারা তাঁর হূিপণ্ড পরিশাধন করে পুনঃস্থাপন করলেন। বোরাক নামক অতি ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন একটি বাহনে চড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে মসজিদুল আকসায় নিয়ে গেলেন। যেখানে যেতে তখন কয়েকদিন লেগে যেত। সেখানে কুদরতিভাবে আগ থেকেই সকল নবী-রাসুলকে উপস্থিত করা হয়েছিল। নবীজি (সা.) তাদের নিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলেন।

এরপর ঊর্ধ্বাকাশে রওয়ানা হলেন। প্রথম আকাশে আদম (আ.), দ্বিতীয় আকাশে ঈসা ও ইয়াহইয়া (আ.), তৃতীয় আকাশে ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আকাশে ইদরিস (আ.), পঞ্চম আকাশে হারুন (আ.), ষষ্ঠ আকাশে মুসা (আ.) ও সপ্তম আকাশে বাইতুল মামুরে ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত্ হয় এবং সকালের সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় হয়। সপ্তম আকাশে অবস্থিত ‘বাইতুল মামুর’ ফেরেশতাদের ইবাদতের স্থান। যেখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা আসেন ও ইবাদত করে প্রস্থান করেন। যাঁরা দ্বিতীয়বার আসার সুযোগ পান না।

অতঃপর নবীজি (সা.)-কে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলো। নবীজি (সা.) বলেন, সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে এত ঊর্ধ্বে পৌঁছে যাই, যেখান থেকে আমি আল্লাহর হুকুম-আহকাম লিপিবদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত ফেরেশতাদের ‘কলমের’ আওয়াজ শুনতে পেলাম। এরপর মহান আল্লাহ নবীজি (সা.)-কে যা দেওয়ার ছিল তা দিলেন। (পরিবর্তনসহ মুসলিম, হাদিস : ১৬২)

নবীজিকে যেসব পাপের শাস্তি দেখানো হয়েছে 

নবীজি (সা.) একদল লোককে দেখলেন, তাদের নখগুলো তামার। নিজেদের নখ দিয়ে তারা (স্বয়ংক্রিয়ভাবে) নিজের গাল ও বুকে আঁঁচড় কাটছে। জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাঈল এরা কারা? বলেন, এরা ওই সমস্ত লোক, যারা গীবত করত এবং মানুষকে লাঞ্ছিত করত। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৭৮)

তিনি আরো দেখলেন, একদল লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে (স্বয়ংক্রিয়ভাবে) কাটা হচ্ছে। ঠোঁট কাটা মাত্র তা পুনরায় জোড়া লেগে পূর্ববত্ হয়ে যেত। জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? জিবরাঈল (আ.) বলেন, এরা বক্তৃতা করত বটে, কিন্তু নিজেরা আমল করত না। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২২১১)

আরো একদল লোক দেখলেন, যাদের পেট ছিল এক একটি গৃহের মতো। পেটের ভেতরটা সর্পে ভর্তি ছিল, যা বাইরে থেকেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? জিবরাঈল (আ.) বললেন, এরা সুদখোর। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৬৪০)

নবীজি (সা.) এ সফরে যে উপহার পেলেন

এ সফরে নবীজিকে বিশেষ তিনটি উপহার দেওয়া হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, সুরা বাকারার শেষ আয়াতগুলো এবং এই উম্মতের যারা শিরক থেকে বেঁচে থেকে মৃত্যুবরণ করবে তাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়ার ঘোষণা। (মুসলিম, হাদিস : ৩২০)

মিরাজ পরবর্তী সকালে মানুষের প্রতিকৃয়া

শবে মিরাজের সকালে নবীজি (সা.) হাতিমে কাবায় বসে আছেন। আবু জাহেলের সাথে দেখা হলে বিদ্রূপের ছলে জিজ্ঞাসা করল ‘কোনো ব্যাপার আছে নাকি?’ নবীজি (সা.) বললেন হ্যাঁ। সে বলল কী? তিনি জবাব দিলেন, আজ রাতে আমার মিরাজ হয়েছে। মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করলেন। সে বিস্ময়ের সাথে বলল, সকল মানুষ তোমার কাছে এসে গেলে তুমি এ ঘটনা বলতে পারবে তো? নবীজি (সা.) দৃঢ়তার সাথে বলেন, হ্যাঁ। সে সবাইকে ডাকল। নবীজি (সা.) পুনরায় বর্ণনা দিলেন। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে মসজিদে আকসারও বিবরণ দিলেন। কিন্তু তারপরও তারা নবীজি (সা.)-কে সত্য নবী হিসেবে মেনে নিতে পারল না। কাফেরই থেকে গেল। (সংক্ষিপ্তরূপে মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৮১৯)

অপরদিকে আবু বকর (রা.) নবীজির মিরাজের কথা শুনে এক আকাশ আস্থা নিয়ে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি তো এর চেয়েও আরো দূরের অনেক জটিল বিষয়েও তাঁকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে আসা আসমানি বার্তাসমূহের ওপর আছে আমার অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় ঈমান। পেলেন ‘সিদ্দীক’ উপাধি। (মুসতাদরাক : ২/৩৬১)

মহান আল্লাহ সকলকে নবীজির মিরাজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা