যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা চরমে, যেখানে অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে বৈশ্বিক ইস্যু—সবই প্রচারণায় গুরুত্ব পাচ্ছে। নাগরিকরা প্রেসিডেন্টসহ আইনসভার সদস্যও নির্বাচন করবেন, ফলে বিশ্বজুড়েই এই নির্বাচনের প্রতি নজর। নির্বাচনে কমালা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাবনা নিয়ে চলছে জল্পনা, নাটকীয় ঘটনাও বাড়ছে।
নির্বাচন কবে?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে ৫ নভেম্বর, যার ফলাফলে নির্বাচিত প্রার্থী ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে চার বছরের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করবেন এবং বৈদেশিক নীতিসহ বিভিন্ন আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখবেন।
প্রধান দল কোনগুলো?
নির্বাচনে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান পার্টি। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নাগরিক অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সামাজিক নিরাপত্তায় বিশ্বাসী, আর রিপাবলিকান পার্টি রক্ষণশীলতা, কম কর, সীমিত সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং অভিবাসন ও গর্ভপাতের নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দেয়।
মূল প্রার্থী কারা?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমালা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে। হ্যারিস, বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। তাঁর রানিং মেট মিনেসোটার গভর্নর টিম ওয়ালজ। এদিকে, ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিযোগিতায় আছেন, ২০১৭-২০২১ পর্যন্ত ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। তার রানিং মেট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জেডি ভান্স, যিনি ২০২২ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করে দ্রুত শীর্ষ রিপাবলিকান নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। রিপাবলিকানরা আশা করছেন ভান্সের ব্যক্তিত্ব শ্রমজীবী ভোটারদের আকৃষ্ট করবে। হ্যারিসের জয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন, অন্যথায় ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হবেন, এবং ভান্স ভাইস-প্রেসিডেন্ট হবেন।
প্রচারণার ইস্যু কোনগুলো?
যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় অভ্যন্তরীণ ইস্যুর পাশাপাশি বৈশ্বিক সংকটগুলোও ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রার্থী কমালা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম বিতর্কে অর্থনীতি, গর্ভপাত আইন, পররাষ্ট্র নীতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া, গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। হ্যারিস অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি ও আবাসন খরচ কমানোর পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন এবং ‘প্রজেক্ট-২০২৫’ নামে একটি ডানপন্থী পরিকল্পনার বিষয়ে ভোটারদের সতর্ক করেছেন। তিনি আরো দাবি করেন, ট্রাম্প ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, যা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে উগ্র ডানপন্থী নীতিগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৈরি।
ট্রাম্প অবশ্য ওই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। গর্ভপাত নীতিও প্রচারণার প্রধান ইস্যু, যেখানে হ্যারিস ট্রাম্পের সমালোচনা করেন, যিনি সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে গর্ভপাতের অধিকার বাতিলে ভূমিকা রেখেছিলেন। গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রসঙ্গেও আলোচনা চলছে, যেখানে ট্রাম্প দাবি করেন তার সময়ে এ যুদ্ধ হতো না; আর হ্যারিস শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান’কে সমর্থন করেছেন।
কারা ভোট দিতে পারেন?
যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সব নাগরিক ভোট দিতে পারেন। নর্থ ডাকোটার বাইরে সব অঙ্গরাজ্যে আগেই ভোটার নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। বিদেশে থাকা মার্কিনিরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারেন। অঙ্গরাজ্যভেদে ভোট দেয়ার সময়সীমা নির্ধারিত থাকে এবং অনেক অঙ্গরাজ্যে আগাম ভোটের সুযোগ রয়েছে। অসুস্থতা, ভ্রমণ বা অনুপস্থিতির কারণে যারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন না, তারা ডাকযোগেও ভোট দিতে পারেন।
ভোট বেশি পেলেই কি প্রেসিডেন্ট?
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন না; বরং ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ব্যবস্থায় নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি ভোট পাওয়া প্রার্থীই জয়ী হন। মেইন ও নেব্রাসকা বাদে বাকি সব অঙ্গরাজ্যে জয়ী প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেক্টোরাল ভোট পান। সাধারণ ভোটে কম পেয়েও ইলেক্টোরাল ভোটে জয়ী হওয়ার উদাহরণে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জর্জ ডব্লিউ বুশও রয়েছেন।
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ আসলে কী?
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ হল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য একটি জটিল ব্যবস্থা, যা দেশের সংবিধানে নির্ধারিত। এটি এক ধরনের নির্বাচক মণ্ডলী, যেখানে ‘ইলেক্টরস’ বা নির্বাচকরা প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ভোট প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতি চার বছরে গঠিত এই কলেজই প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে।
ইলেক্টরসের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে, যা সেনেটর ও প্রতিনিধি সংখ্যা যোগফলে নির্ধারিত হয়। জনসংখ্যা বেশি রাজ্যগুলোর বেশি ইলেক্টোরাল ভোট থাকে। সবচেয়ে বড় ছয়টি স্টেট হলো ক্যালিফোর্নিয়া (৫৫), টেক্সাস (৪০), নিউইয়র্ক (২৯), ফ্লোরিডা (২৯), ইলিনয় (২০) এবং পেনসিলভেনিয়া (২০)।
সাধারণত, রাজ্যগুলো তাদের ইলেক্টোরাল ভোট সেই প্রার্থীকে দেয়, যিনি সরাসরি ভোটে জয়ী হন। তবে, একজন প্রার্থী পপুলার ভোট বেশি পেয়ে থাকলেও, ইলেক্টোরাল ভোটে পিছিয়ে পড়লে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারতে পারেন, যেমন ২০০০ সালে আল গোর এবং ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের ক্ষেত্রে।
ইলেক্টোরাল ভোটে ‘টাই’ হলে কী হবে?
ইলেক্টোরাল ভোটে যদি কোনো প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তবে প্রতিনিধি পরিষদ শীর্ষ তিন প্রার্থী থেকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে এবং সিনেট ভাইস-প্রেসিডেন্ট বাছাই করে। তবে এ ঘটনা মার্কিন ইতিহাসে একবারই ঘটেছে। ১৮২৪ সালে এভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জন কুইনসি অ্যাডামস।
নির্বাচনের ফলাফল কখন জানা যাবে?
নির্বাচনের ফলাফল জানতে কিছুদিন সময় লাগতে পারে। ভোটগ্রহণ স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় বন্ধ হয় এবং গণনা শুরু হয়। কিন্তু কিছু অঙ্গরাজ্যে, যেমন আলাস্কা ও হাওয়াই, ভোট গণনা চলতে থাকে। ফলে, ফলাফল জানাতে সময় লাগে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউ ইয়র্কে ভোর তিনটায় বিজয়ী ঘোষণা পেয়েছিলেন, তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করতে কয়েক দিন লেগেছিল, কারণ সব ভোট গণনা করতে সময় লাগছিল।
সুইং স্টেটগুলোর ভোট গণনা বা আইনি জটিলতা থাকলে বিজয়ী সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আরও সময় লাগতে পারে। ২০০০ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশ ও অ্যাল গোরের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছিল, যা ফ্লোরিডা রাজ্যের ভোট গণনায় গিয়ে ঠেকে। সেখানে ফলাফল পেতে কয়েক সপ্তাহ আইনি লড়াইয়ের পর গোর পরাজয় স্বীকার করেন। আনুষ্ঠানিক বিজয় ঘোষণা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হয়, এরপর জানুয়ারির শুরুতে কংগ্রেসে গণনা করা হয়।
বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণার পর কী হয়?
নির্বাচনের পর বিজয়ী প্রার্থীদের সরকার গঠনে কিছু সময় দেওয়া হয়, যাকে ‘রূপান্তরকালীন সময়’ বলা হয়। এই সময়ে নতুন প্রেসিডেন্ট মন্ত্রিসভার সদস্যদের নির্বাচন করেন। জানুয়ারিতে, ক্যাপিটল ভবনে ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের অভিষেক ও শপথ অনুষ্ঠিত হয়। অভিষেকের পর নতুন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে যান তার চার বছরের মেয়াদ শুরু করার জন্য। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, যা ১৯৫১ সালে ২২তম সংশোধনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি আরও যে নির্বাচন হচ্ছে
৫ই নভেম্বরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি ভোটাররা নতুন আইনসভা সদস্যদেরও নির্বাচন করবেন। মার্কিন কংগ্রেস দু’কক্ষবিশিষ্ট; নিম্নকক্ষে ৪৩৫টি আসনে ভোট হবে, যা দুই বছর মেয়াদী। এছাড়া, সেনেটে ৩৪টি আসনে ভোট হবে, যেখানে সদস্যদের মেয়াদ ছয় বছর। বর্তমানে প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের এবং সেনেটে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। উভয় দল এবার উচ্চকক্ষে তাদের সংখ্যা বাড়াতে এবং প্রতিনিধি পরিষদে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
‘সুইং স্টেট’ কোনগুলি?
বেশিরভাগ মার্কিন রাজ্য ধারাবাহিকভাবে একই দলের সমর্থন করে, যেগুলোকে ‘রেড স্টেট’ বা ‘ব্লু স্টেট’ বলা হয়। তবে কিছু রাজ্য রয়েছে, যেগুলো ‘সুইং স্টেট’ বা ‘বেগুনি রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত, যেখানে ভোটের ফলাফল পূর্বনির্ধারণ করা যায় না। এই রাজ্যগুলো নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসাবে কাজ করে, কারণ এখানে ভোটের মাধ্যমে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। ২০১৬ সালে অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাডা, পেনসিলভেনিয়া ও উইসকনসিন এই ধরনের রাজ্য হিসেবে উত্থিত হয়েছিল, যেখানে প্রার্থীরা প্রচারণায় বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করেন।